প্রাথমিক শিক্ষকদের দেদার বদলির জেরে বিভিন্ন স্কুলে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্যাহত হচ্ছে পঠনপাঠন। এই পরিস্থিতিতে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (প্রাথমিক) কবিতা মাইতিকে তলব করে বদলি পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত খোঁজ নিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি। বুঝিয়ে দিলেন, বিষয়টি আগেই তাঁর নজরে আনা উচিত ছিল। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত না-দেখে কেন এ ভাবে বদলির আবেদনে সিলমোহর লাগানো হল, জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাছে তা-ও জানতে চান তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুর একটা নাগাদ কবিতাদেবীকে ডেকে পাঠান জেলাশাসক। তলব পেয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যেই নিজের দফতর থেকে জেলাশাসকের দফতরে আসেন কবিতাদেবী। এরপরই কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হত হয় তাঁকে। পরে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (প্রাথমিক) বলেন, “জেলাশাসক ডেকেছিলেন। তাই গিয়েছিলাম। উনি যা যা জানতে চেয়েছেন, সবই জানিয়েছি। বদলি তো আমরা করি না। প্রাথমিক সংসদ করে।” ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে সামঞ্জস্য আনতে কী পদক্ষেপ করা হবে? কবিতাদেবীর জবাব, “সংসদ নিশ্চয়ই পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ করবে।”
গত ফেব্রুয়ারির শেষে জেলায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি শুরু হয়। সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে প্রায় বারোশো শিক্ষক বদলি হন। এরপরই বিভিন্ন স্কুলে সমস্যা দেখা দেয়। এক দফায় এত শিক্ষকের বদলি নজিরবিহীন বলেই দাবি একাংশ শিক্ষকের। অভিযোগ ওঠে, তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নিরিখেই শিক্ষক বদলি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ বিধি মানা হয়নি। ফলে, বহু প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। সংসদ কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, তাঁরা বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে সামঞ্জস্য আনারই চেষ্টা করেছিলেন। আগে এক সমীক্ষা হয়। সংসদের তরফেই ওই সমীক্ষা হয়েছিল। তখন অসামঞ্জস্যের ছবি উঠে আসে। দেখা যায়, শহর এলাকার স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম, তুলনায় শিক্ষক-শিক্ষিকা বেশি। আর গ্রামের স্কুলে ছাত্রছাত্রী বেশি, অথচ পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই। সংসদ কর্তৃপক্ষের দাবি, এ বারের বদলির উদ্দেশ্যই ছিল, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে ভারসাম্য আনা। তাড়াহুড়ো করে প্রায় বারোশো শিক্ষকের বদলি করতে গিয়েই কিছু সমস্যা হয় বলে সংসদ জানিয়েছিল। একাংশ শিক্ষক অবশ্য এই দাবিকে হাস্যকর বলেই মনে করছেন। তাঁদের যুক্তি, সংসদের উদ্দেশ্য যদি সামঞ্জস্য আনাই হয়, তাহলে শহরের যে সব স্কুলে আগে থেকেই অতিরিক্ত শিক্ষক ছিলেন, সেখানে নতুন করে আরও শিক্ষক আসেন কী করে। দেদার বদলির কথা জানতে পেরেই জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের কাছে রিপোর্ট তলব করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। সংসদের এক সূত্রে খবর, শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। এ বারও জেলাশাসকও বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিলেন।
বৃহস্পতিবার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শককে নিজের দফতরে তলব করেন জেলাশাসক। সরাসরি জানতে চান, কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। প্রশাসন সূত্রের খবর, কবিতাদেবীকে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করেন জেলাশাসক। জিজ্ঞেস করেন, মেদিনীপুর শহরের মুক্তারঞ্জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগে ৩ জন শিক্ষক ছিলেন। নতুন করে আরও ৪ জন শিক্ষক এসেছেন। অথচ, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬১। এটা কী ঠিক? শালবনির ভুতাশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথাও জানতে চান ডিএম। ওই স্কুলে ২ জন স্থায়ী শিক্ষক ছিলেন। ২ জনেরই বদলি হয়েছে। এখন ৪১ জন ছাত্রছাত্রীকে পড়াচ্ছেন একমাত্র পার্শ্বশিক্ষক। উত্তরে কবিতাদেবী জানান, বদলির পর বেশ কিছু স্কুলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি জানান, বদলির বিষয়টি সংসদ দেখে। এ ক্ষেত্রে তাঁর সরাসরি কিছু করণীয় নেই। এ-ও জানান, এখন বদলি প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। সংসদের তরফে অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকদের মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, আর কাউকে ‘রিলিজ অর্ডার’ দেওয়া যাবে না। সংসদের বদলির নির্দেশ থাকলেও দেওয়া যাবে না।
পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রায় ৪৭০০টি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। স্থায়ী শিক্ষক রয়েছেন ১৬২০০ জন। জেলায় প্রাথমিক পড়ুয়ার সংখ্যা সাড়ে ৩ লক্ষের কিছু বেশি। আগে স্কুলে ৪০ জন ছাত্রপিছু এক জন শিক্ষক থাকার কথা ছিল। এখন ৩০ জন ছাত্রপিছু এক জন শিক্ষক থাকার কথা। জানা গিয়েছে, বদলি পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রাথমিক স্কুলগুলোর অবস্থা ঠিক কেমন, স্কুলগুলোর ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতই বা কী, তা জানতে চেয়ে শীঘ্রই অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকদের কাছে চিঠি পাঠাবেন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (প্রাথমিক)।