জেলা সিপিএমে এ বার দীপক যুগের অবসান

তিনি প্রথম দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি। সেই থেকে অবিভক্ত মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদক পদ তাঁর জন্যই বরাদ্দ ছিল। ২০০২ জেলা ভাগের পর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক ছিলেন দীপক সরকার। এ বার সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে চলেছেন তিনি। আগামী ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সিপিএমের জেলা সম্মেলনেই বেছে নেওয়া হবে নতুন জেলা সম্পাদক।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৮
Share:

জেলা সম্মেলনের সভাস্থল ঘুরে দেখছেন দীপক সরকার। —নিজস্ব চিত্র।

তিনি প্রথম দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি। সেই থেকে অবিভক্ত মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদক পদ তাঁর জন্যই বরাদ্দ ছিল। ২০০২ জেলা ভাগের পর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক ছিলেন দীপক সরকার। এ বার সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে চলেছেন তিনি। আগামী ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সিপিএমের জেলা সম্মেলনেই বেছে নেওয়া হবে নতুন জেলা সম্পাদক।

Advertisement

২০১২ সালে সিপিএমের দলী সিদ্ধান্ত হয়েছে, তিন দফার বেশি কেউ সম্পাদক পদে থাকতে পারেন না। সেই নিয়মেই সরতে হচ্ছে দীপকবাবুকে। সিপিএম সূত্রে খবর, শুক্রবার সকালে দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের এক বৈঠক হয়। সেখানেই দীপকবাবু বুঝিয়ে দেন, জেলায় দলের ব্যাটন এ বার তিনি নতুন কারও হাতে তুলে দেবেন। কে হবেন নতুন সম্পাদক? দীপকবাবুর জবাব, “এটা সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হবে। জেলা কমিটির সদস্যরাই জেলা সম্পাদক নির্বাচিত করবেন।” দল সূত্রে খবর, কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এমন এক সদস্যই জেলা সম্পাদক হচ্ছেন।

প্রায় সিকি শতক সিপিএমের জেলা সম্পাদক পদে ছিলেন দীপকবাবু। আগে অবিভক্ত মেদিনীপুরের, পরে পশ্চিম মেদিনীপুরের। প্রয়াত সুকুমার সেনগুপ্তের হাত ধরে দীপকবাবুর সক্রিয় রাজনীতিতে আসা। এক সময় মেদিনীপুর নির্মল হৃদয় আশ্রমের শিক্ষক ছিলেন। পরে মেদিনীপুর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। সেটা ১৯৬৩ সাল। পরের বছর এখান থেকে ‘ছাঁটাই’ হন। অধ্যাপনার সুযোগ আসে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর কলেজে। পরে ফের মেদিনীপুর কলেজে ফিরে আসেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন দীপকবাবু। ১৯৮৪ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। ২৩ বছর ১ মাস চাকরি করে ইস্তফা দিলেও পেনশন, গ্র্যাচুইটি পাননি। আবেদনই করেননি।

Advertisement

দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়েই সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন দীপকবাবু। ১৯৮৫ সালে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য হন। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ থেকে ১৯৮৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর টানা প্রায় এগারো বছর মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। এক সময় আরটিও বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। যুক্ত ছিলেন ভারতীয় গণনাট্যের সঙ্গে। ১৯৯১ সালে কাঁথি সম্মেলনে সুকুমার সেনগুপ্তই অবিভক্ত মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক হন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে পরের বছর তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। দলের এক সূত্রে খবর, সেই সময় জেলা সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে ছিলেন শিবরাম বসু। তবে শেষমেশ সম্পাদক হন দীপকবাবু। তখন সূর্যকান্ত মিশ্র, তরুণ রায়, লক্ষ্মণ শেঠদের সঙ্গে দীপকবাবুর ‘ঘনিষ্ঠতাই’ ছিল। পরে পরিস্থিতি পাল্টায়। যাঁদের সমর্থনে জেলা সম্পাদক হয়েছিলেন, তাঁদের একাংশের সঙ্গেই দীপকবাবুর দূরত্ব বাড়ে।

ক্রমে জেলা সিপিএমে দু’টি গোষ্ঠী তৈরি হয়। এক দিকে দীপক সরকারের অনুগামীরা, অন্য দিকে সূর্যকান্ত মিশ্রের অনুগামীরা। দলের এক সূত্রের দাবি, জেলায় নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সূর্যবাবুকে মন্ত্রী করে রাজ্যে পাঠাতে কম তদারকি করেননি দীপকবাবু। ১৯৯১ সালের বিধানসভা ভোটে নারায়ণগড় থেকে নির্বাচিত জিতে মন্ত্রিও হন সূর্যবাবু। এর আগে ১৯৭৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ১৯৯১ সালের ১৮ এপ্রিল টানা প্রায় তেরো বছর অবিভক্ত মেদিনীপুরের জেলা সভাধিপতি ছিলেন তিনি। মন্ত্রী হয়ে সূর্যবাবু রাজ্য-রাজনীতিতে পা রাখার পর জেলা রাজনীতিতে দীপকবাবুর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যত দিন গিয়েছে, ততই একঘরে হয়েছেন সূর্য-অনুগামীরা। এক সময় দাঁতন, নারায়ণগড়, কেশপুর, মেদিনীপুর-সহ জেলার বড় একটা এলাকা ছিল সূর্য-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে। পরে পরিস্থিতি পাল্টায়। বিশেষ করে ২০০৫ সালে চন্দ্রকোনা রোড সম্মেলনের পর থেকে। ওই সম্মেলনে জেলা সম্পাদকের পদ নিয়ে দীপক সরকারের সঙ্গে তরুণ রায়ের লড়াইয়ের উপক্রম হয়। কৃষকসভার রাজ্য নেতা তরুণবাবু পরিচিত সূর্য-অনুগামী বলে। শেষমেশ তত্‌কালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বসু পরিস্থিতি সামাল দেন। জেলা সম্পাদক থেকে যান দীপকবাবুই। অভিযোগ, এরপর থেকে আরও বেশি করে বিরোধী গোষ্ঠীর লোকেদের একঘরে করার চেষ্টা হয়। পরিস্থিতি বুঝে অনেকে দীপক-শিবিরের কাছে আত্মসমর্পণও করেন অনেকে। ২০১০ সালে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন দীপকবাবু।

বিতর্ক কখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি। তবে সব বিতর্কের উর্ধ্বে জেলায় দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দীপকবাবুই। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার প্রশংসা শোনা যায় বিরোধী দলের নেতাদের মুখেও। এমনকী, দলের তাঁর কট্টর সমালোচকরাও সাংগঠনিক দক্ষতার প্রশ্নে দীপকবাবুর প্রশংসা করেন। দলের এক জেলা নেতার কথায়, “দীপকদার নিয়মানুবর্তিতা এবং সময়ানুবর্তিতা শেখার মতো।”

দীপকবাবুর জমানাতেই অবশ্য জেলায় ভরাডুবি হয়েছে সিপিএমের। ২০১১ সালের বিধানসভা থেকে একের পর নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছে দল। কোণঠাসা এই অবস্থায় বদলেছে জেলা সিপিএমের অন্দরের ছবিটাও। গত বিধানসভা ভোটের আগে জেলায় দলের কর্মসূচিতে বিশেষ দেখা যেত না সূর্যবাবুকে। অথচ লোকসভা ভোটের পর সেই সূর্যবাবুকেই মেদিনীপুরে দলীয় এক সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দীপকবাবু। গত ফেব্রুয়ারিতে মেদিনীপুরে এসে দলের এক প্রকাশ্য সভায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন, ‘নেতাইয়ে আমাদের ছেলেরা ভুল করেছিল।’ এ নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়। বিষয়টিতে বুদ্ধবাবুর পাশে দাঁড়ায়নি আলিমুদ্দিনও। অথচ এ ক্ষেত্রে জেলা সিপিএমের পাশে দাঁড়ান সূর্যবাবু। তিনি জানান, নেতাই বিচারাধীন বিষয়। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তিনি মন্তব্য করেন না। এরপরই দীপক এবং সূর্য-অনুগামীরা কিছুটা হলেও কাছাকাছি আসা শুরু করেন।

জেলা সম্পাদক হিসেবে দীপকবাবুর শেষ জেলা সম্মেলনেও থাকবেন সূর্যবাবুর। এখন দেখার কার হাতে জেলায় দলের ব্যাটন তুলে দেন দীপক সরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement