বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস খড়্গপুরে। নিজস্ব চিত্র।
পদ্ম ফুটল রেলশহরে।
মিনি ইন্ডিয়া খড়্গপুর বরাবর কংগ্রেসের ‘শক্ত ঘাঁটি’ বলেই পরিচিত। যে কোনও নির্বাচনে এই রেলশহরে এগিয়ে থেকেছে কংগ্রেস। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বিজেপি। মেদিনীপুর কেন্দ্রে একমাত্র খড়্গপুর সদর বিধানসভা এলাকাতেই চতুর্থ স্থান পেয়েছে কংগ্রেস। প্রথম স্থানে বিজেপি। বছর ঘুরলে খড়্গপুরে পুরসভা নির্বাচন। তার আগে বিজেপির পালে এই হাওয়া রেলশহরের রাজনীতিতে নতুন অঙ্কের জন্ম দিল বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
খড়্গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বহু বছর ধরে জিতে আসছেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা ‘চাচা’ জ্ঞানসিংহ সোহনপাল। খড়্গপুর পুরসভাও কংগ্রেসের দখলে থেকেছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত পুর-এলাকার বাইরে ছিল রেল এলাকা। ২০১০ সালের পুর নির্বাচনে অবশ্য ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাসের জেরে রেল এলাকাও পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে বর্তমানে খড়্গপুর সদর বিধানসভা মানে গোটা পুর-এলাকা। ২০১০ সালে শেষ পুর নির্বাচনে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুরসভার দখল নিয়েছিল তৃণমূল। তবে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে কংগ্রেস ছিল প্রথম আর দ্বিতীয় বাম। তৃতীয় স্থান পেয়েছিল তৃণমূল ও চতুর্থ বিজেপি। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস-তৃণমূল জোট এই শহরে এগিয়ে ছিল। বিজেপি ছিল তৃতীয় স্থানে। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটেও ছবিটা ছিল একই। এ বার লোকসভা নির্বাচনে সব হিসেব পাল্টে গিয়েছে। খড়্গপুর সদর বিধানসভায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৫১,১৫২টি। চতুথর্ স্থানে থাকা কংগ্রেস পেয়েছে ২১,৩১৬টি ভোট। ৪০,১৩৫টি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তৃণমূল এবং ২৯,৯৮৪টি ভোট পেয়ে তৃতীয় সিপিআই।
রেলশহরে বিজেপির এই উত্থানের কারণ নিয়ে শুরু হয়েছে জোর জল্পনা। মনে করা হচ্ছে, বহু ভাষাভাষির শহর খড়্গপুরে ‘মোদী হাওয়া’র জেরেই এই ফল। শহরের ২ লক্ষ ৪ হাজার ১৯৪ জন ভোটারের প্রায় ৪৭ শতাংশই অবাঙালি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন তেলুগু, গুজরাতি, মারোয়ারি জনতা। রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ, এই অবাঙালিদের বেশিরভাগের সমর্থনই মোদীর অনুকূলে গিয়েছে। সে কথা মানছেন, বর্ষীয়ান কংগ্রেস বিধায়ক চাচাও। তাঁর মতে, “খড়্গপুর তো দেশের বাইরে নয়। সারা দেশে যে হাওয়া এসেছে তাতেই এই ফল।” ১৯৭৭ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল বলে মনে করিয়ে দেন চাচা। সেই সঙ্গে জানান, সর্বস্তরে এই ফল পর্যালোচনা করা হবে। রাজনৈতিক মহলের মতে, কংগ্রেস ও বামেদের ভোটেই ভাগ বসিয়েছে বিজেপি। তৃণমূলের শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরীর কথায়, “দেশে মোদী হাওয়ার জেরে রেল শহরের কংগ্রেস ও বাম ভোটারদের অধিকাংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন।” পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়াও মনে করেন, ‘মিনি ইন্ডিয়া’ খড়্গপুরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ রয়েছেন। ফলে দেশব্যাপী যে মোদী ম্যাজিক দেখা গিয়েছে, তারই প্রতিফলন হয়েছে এখানে।
আগামী বছর খড়্গপুরে পুরভোট। সেখানেও বিজেপি একটা ‘ফ্যাক্টর’ হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। লোকসভা ভোটের এই ফল আগামী পুর- নির্বাচনে ধরে রাখতে তৎপর বিজেপি-ও। দলের জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের এই ভাল ফলের পিছনে মোদী হাওয়াই আসল কারণ। তবে এই হাওয়া আগামী নির্বাচনেও ধরে রাখার জন্য যা করণীয় করব। সাত দিনের মধ্যেই সাংগঠনিকভাবে আমরা আলোচনায় বসব। আমাদের আশা পুরসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে এর থেকেও ভাল ফল হবে।”
২০১০ সালের পুর-নির্বাচনে ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ১৫টি। কংগ্রেস ১২টি, বামেরা ৬টি, বিজেপি ও নির্দল একটি করে আসনে জয়ী হয়। ২০১৩ সালের ৫ অগস্ট অবশ্য অনাস্থা ভোটে তৃণমূলকে সরিয়ে ফের পুরবোর্ড গড়ে কংগ্রেস। এ বার লোকসভা ভোটের ধাক্কায় তাই কিছুটা মনমরা কংগ্রেস। বিজেপির শহর সভাপতি প্রেমচাঁদ ঝাঁ জানালেন, কংগ্রেসের পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডের ওয়ার্ড থেকেও ‘লিড’ পেয়েছেন দলের প্রার্থী প্রভাকর তিওয়ারি। তবে পুরভোটে বিজেপি হালে পানি পাবে না বলেই দাবি তৃণমূলের। দলের শহর সভাপতি দেবাশিসবাবু বলেন, “রাজ্যে তৃণমূল সরকারের উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে মানুষ পুরসভায় ভোট দেবেন।” খড়্গপুরের কংগ্রেস পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডে অবশ্য সারা দেশের ভোটের হিসেবের প্রেক্ষিতে পুরভোটের অঙ্ক কষা উচিত নয় বলে মনে করেন। সিপিএমের জোনাল সম্পাদক মনোজ ধরও এ নিয়ে আগাম পর্যালোচনা করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন।
কংগ্রেসের অন্দরে অবশ্য বিজেপির এই উত্থান নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। খোদ চাচা মানছেন, “এখন আমরা এই ফল নিয়ে চিন্তিত।” তবে পুরসভা বা আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ফল কংগ্রেসের অনুকূলে যাবে বলেই আশা প্রবীণ কংগ্রেস বিধায়কের।