কপ্টার নিয়ে ক্ষুব্ধ মমতার হাসি ফেরাল জনতাই

কপ্টার উড়বে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবরটা পান সোমবার সকালে। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের তিন প্রান্তে তিনটি সভা। লোকজন সব অপেক্ষা করছে। সড়কপথে প্রথম সভায় পৌঁছতে পৌঁছতেই বেলা গড়িয়ে বিকেল। মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজও স্বভাবতই বেশ চড়া। কপ্টার বিভ্রাটের পিছনে চক্রান্ত আছে বলে অভিযোগ তুললেন। সেই সঙ্গে জেলা নেতাদের এক-একটি জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। হাজার হোক, গরম-রোদ উপেক্ষা করে ঠায় বসে-দাঁড়িয়ে আছে মানুষগুলো। সেই ভিড় মমতার পিছু ছাড়েনি রাত পর্যন্ত। আর সেই ভিড়ই শেষ পর্যন্ত তাঁর মুখে হাসি ফুটিয়েছে।

Advertisement

সুমন ঘোষ ও অভিজিৎ চক্রবর্তী

কেশিয়াড়ি ও গড়বেতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৭
Share:

কপ্টার উড়বে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবরটা পান সোমবার সকালে। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের তিন প্রান্তে তিনটি সভা। লোকজন সব অপেক্ষা করছে। সড়কপথে প্রথম সভায় পৌঁছতে পৌঁছতেই বেলা গড়িয়ে বিকেল।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজও স্বভাবতই বেশ চড়া। কপ্টার বিভ্রাটের পিছনে চক্রান্ত আছে বলে অভিযোগ তুললেন। সেই সঙ্গে জেলা নেতাদের এক-একটি জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। হাজার হোক, গরম-রোদ উপেক্ষা করে ঠায় বসে-দাঁড়িয়ে আছে মানুষগুলো। সেই ভিড় মমতার পিছু ছাড়েনি রাত পর্যন্ত। আর সেই ভিড়ই শেষ পর্যন্ত তাঁর মুখে হাসি ফুটিয়েছে।

বিকেল ৩টে নাগাদ কেশিয়াড়ি পৌঁছে মঞ্চ থেকেই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এ নেমে পড়েন তৃণমূল নেত্রী। মাইক হাতে মমতা বলেন, “দীনেন (জেলা তৃণমূল সভাপতি দীনেন রায়) তুই সন্ধ্যাদিকে (সন্ধ্যা রায়) নিয়ে গড়বেতা চলে যা। মৃগেনদা (বিধায়ক মৃগেন মাইতি) আপনি কেশপুর চলে যান। শশাঙ্ক (জেলা নেতা শশাঙ্ক পাত্র) তুমিও মৃগেনদার সঙ্গে যাও।” প্রতিটি সভা দ্রুত শেষ করতে তৃণমূল নেত্রী বক্তব্যও ছিল সংক্ষিপ্ত।

Advertisement

তবে হেলিকপ্টার নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ জানান বিশদে। কেশিয়াড়িতে প্রথম সভায় গিয়ে কপ্টার-বিভ্রাট নিয়ে বেজায় খেপে গিয়ে তিনি বলেন, “কপ্টার খারাপ হয়েছে না চক্রান্ত, পরে দেখব। আমাকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আমার জেদ ওরা জানে না। আমি ভাঙি, কিন্তু মচকাই না।” কেশপুরের সভাতেও মমতা বলেন, “সকালে বলল কপ্টারে টেকনিক্যাল সমস্যা। টেকনিক্যাল না পলিটিকাল জানি না।”

প্রথমে সভায় হাজির নেতা-নেত্রীদের একাংশের মনে হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী যে কপ্টার খারাপের কথা বলেছেন, সেটা হয়তো বেহালায় থাকা পবন হংস কপ্টার। কিন্তু সেটি এ দিনও দিব্যি উড়েছে। এই কপ্টারের জন্য পবন হংস সংস্থাকে মাসে ৫০ ঘণ্টার ভাড়া দেয় রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী এই কপ্টারে বেশ কয়েক বার চড়েছেন। কিন্তু এখন তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান নয়, তৃণমূল নেত্রী হিসেবে প্রচারে যাচ্ছেন। তাই নির্বাচনের দিন ঘোষণার পরে তিনি রাজ্য সরকারের ভাড়া নেওয়া ওই কপ্টার ব্যবহার করতে পারবেন না।

তা হলে কোন কপ্টারে আসার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর?

প্রশাসন সূত্রে খবর, গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী মালদহ সফরের জন্য মুম্বই থেকে ভাড়া করে আনা হয় ‘গ্লোবাল ভেকট্রা হেলিকর্প’ সংস্থার একটি কপ্টার। এ দিনও সেটির আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি। সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীকে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই তাঁকে হেলিকপ্টার খারাপ হওয়ার কথা জানানো হয়। তখন তিনি পবন হংসের হেলিকপ্টার চেপে মেদিনীপুর যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেই মতো হেলিকপ্টারটি বেহালা থেকে উড়িয়ে আনা হয় রেসকোর্সে। কিন্তু নির্বাচনী বিধিভঙ্গের আশঙ্কা থাকায় শেষমেশ গাড়িতে চেপেই মমতা রওনা দেন।

মেদিনীপুর কেন্দ্রের প্রার্থী অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের সমর্থনে কেশিয়াড়িতে, ঝাড়গ্রামের প্রার্থী চিকিৎসক উমা সরেনের সমর্থনে গড়বেতায় ও ঘাটাল কেন্দ্রের তারকা প্রার্থী দেবের সমর্থনে কেশপুরে সভা ছিল এ দিন। তিনটি জায়গাতেই দীর্ঘদিন পরে সভা করলেন মমতা। ফলে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের অন্ত ছিল না।

কেশিয়াড়ির সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ১টায়। দুপুর ৩টে নাগাদ যখন সভা শুরু হয়, তখনও কেশিয়াড়ি জগন্নাথ মাঠে হাজার দশেকের জমাটি ভিড়। মমতার সঙ্গী দুই তারকা সন্ধ্যা রায় এবং দেব। দেব আসার আগাম খবর ছিল না। তাই ‘খোকাবাবু’র আগমন বার্তা রটতেই পিল পিল করে লোক আসতে শুরু করে। আগেই ভিড়ের চাপে সভার দু’দিকের ব্যারিকেড সরিয়ে দিতে হয়েছিল। শুধু যে দিকে মমতার ঢোকার এবং তৃণমূল নেতাদের বসার বন্দোবস্ত হয়েছিল, সে দিকটায় ব্যারিকেড রাখা হয়। কিন্তু দেবকে দেখতে আকুল জনতার ভিড়ে শেষমেশ সেই ব্যারিকেডও সরিয়ে দিতে হয় পুলিশকে। ভিড়ে-গরমে তিন জন অসুস্থও হয়ে পড়েন। হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁদের। দু’ঘণ্টা দেরি হওয়ায় তৃণমূল নেত্রী কেশিয়াড়ির জনতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। দেব এবং সন্ধ্যাদেবীর সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “এঁরা দু’জনই আমার খুব প্রিয় প্রার্থী।” তারপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় শুরু করেন রাজনৈতিক আক্রমণ।

গড়বেতায় দ্বিতীয় সভা শুরু করতে করতেই এ দিন বিকেল ৫টা বেজে যায়। এখানেও দুপুরবেলা থেকেই চড়া রোদ মাথায় করেই লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। গড়বেতা হাইস্কুলের মাঠ ও আশপাশ মিলিয়ে অন্তত হাজার সত্তর লোকের জমায়েত হয়েছিল বলেই পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। সভা চলাকালীন ভিড়ের চাপে একটা দিকে চেয়ার ছোড়াছুড়ির উপক্রম পর্যন্ত হয়েছিল। মমতা তা দেখে বলে ওঠেন, “নিশ্চয় কেউ গোলমাল পাকাচ্ছে। সব কিন্তু ক্যামেরাবন্দি হয়ে থাকছে। কেউ রেহাই পাবে না।” তবে পুলিশ দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নেয়।

গড়বেতার সভায় সন্ধ্যা রায় যাননি। মমতার সঙ্গে ছিলেন দেব এবং ঝাড়গ্রামের চিকিৎসক প্রার্থী উমা সরেন। দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেন, “সুন্দর ফুটফুটে দু’টো ছেলেমেয়ে! আপনারা এঁদের জেতাবেন তো?” এই সভায় দেব জানান, তরুণ সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেই তাঁর ভোটে দাঁড়ানো।

টলিউড সুপারস্টারের কথায়, “অল্পবয়সীদের বড় অংশ ভোটই দেয় না। তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। দিদির (মমতার) সম্মান রাখতে হবে। দেখতে হবে বাংলা যেন দিল্লিকে কাঁপায়।”

এই সূত্র ধরেই কেন্দ্রের বঞ্চনা ও দিল্লিতে সরকার গঠনে তৃণমূলের নির্ণায়ক ভূমিকা প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “আমরা দিল্লির চাকর-বাকর নই। বাংলা দিল্লি যাবে না। দিল্লি বাংলায় আসবে।”

কেশপুরে সভা আরম্ভ করতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে যায়। এখানে মমতার পাশে ছিলেন দেবই। তিনি যে কেশপুরেরই ছেলে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে দেব জনতার আশীর্বাদ চান। রাত ৮টায় সভা শেষ হওয়া পর্যন্ত স্কুলমাঠে হাজার কুড়ির ভিড়টা এতটুকু পাতলা হয়নি। সভা শেষে তো মমতা-দেবের ছবি তুলতে মঞ্চের সামনে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মমতাকেও হাসিমুখে বলতে শোনা যায়, “এ বার তো তোরা স্টেজটাই ভেঙে দিবি।”

ভ্যাপসা গরমে দীর্ঘ অপেক্ষায় রাত গড়ালেও বাঁধভাঙা ভিড় আর উচ্ছ্বাস যে অটুট ছিল!

(সহ-প্রতিবেদন: সুনন্দ ঘোষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement