শালবনির কাছারী রোডে চলছে আলু বীজ পোঁতা। ছবি: কিংশুক আইচ।
আলু সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রাজ্য সরকার। তাই নিয়ে ক্ষোভ জমছে ব্যবসায়ী ও হিমঘর মালিকদের মধ্যে। সরকারের দাবি, তাঁরা মজুতদারি, কালোবাজারি রুখে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে চান। আর ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকারের অপরিণামদর্শিতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবেন চাষি এবং হিমঘর ব্যবসায়ীরা।
মাস তিনেক আগে জারি করা রাজ্য সরকারের একটি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, চলতি বছরে কোনও ব্যক্তি ২০০ মেট্রিক টনের বেশি আলু সংরক্ষণ বা মজুত করতে পারবেন না। কোনও ব্যবসায়ীকে বেনামে সংরক্ষণ করার সুযোগ দিলে হিমঘরের মালিক, অংশীদার বা কর্মচারীরা শাস্তি পাবেন। ব্যবসায়ী ও হিমঘর মালিকদের মতে, সংরক্ষণের সীমা বেঁধে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা কম আলু কিনবেন। ফলে বাজারে আলু কেনায় প্রতিযোগিতা তৈরি না হলে, চাষিদেরও দাম মিলবে না।
হিমঘর অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সহ সভাপতি পতিতপাবন দে-র কথায়, “গত বছর এই ধরনের বাধ্যবাধকতা ছিল না। তা সত্ত্বেও ১৩ শতাংশ হিমঘর খালি ছিল। এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে, আলু রাখতে চান এমন কেউ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হননি। এ বার এই বিজ্ঞপ্তি ব্যবসায়ীদের আরও নিরুত্সাহ করবে। ফলে হিমঘর শিল্প ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।” পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আলু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফণীভূষণ দে বলেন, “এই আইনি কড়াকড়ির ফলে আলু শিল্পটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আলু পচনশীল পণ্য। ছোট চাষিদের পক্ষে হিমঘরে দীর্ঘ দিন আলু মজুত রাখা সম্ভব নয়।”
কিন্তু বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তো রয়েই যাচ্ছে। কৃষি দফতরের সঙ্গে যুক্ত এক কর্তা বলেন, “খাতায়-কলমে কিন্তু হিমঘরে আলু রাখেন চাষিরাই। কিছু আলু রাখেন হিমঘর মালিক এবং অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ী। ২০০ মেট্রিক টনের বেশি আলু মজুত রেখেছেন কোন ব্যবসায়ী, আমাদের কাছে সে তথ্য নেই। যদি ব্যবসায়ীরা তা রাখতে চান, আমাদের এতদিন জানাননি কেন?”
আলু ব্যবসাটা বাস্তবে হয় ঘুরপথে। কোনও বড় ব্যবসায়ী একাধিক ব্যক্তির নামে আলু মজুত রাখেন হিমঘরে। তার রসিদ (‘আলু বন্ড’) কেনাবেচাও চলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। শেষ অবধি এক এক জন্য ব্যবসায়ীর কাছে কয়েক হাজার মেট্রিক টন আলুর মালিকানা চলে আসে। এ ভাবে গোটা রাজ্যের ৯৫ লক্ষ মেট্রিক টন আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন শ’দেড়েক ব্যবসায়ী। ফলে দামের নিয়ন্ত্রণও অনেকটাই থাকে তাঁদের হাতে। এই পরিস্থিতিই বদলাতে চাইছে রাজ্য সরকার। কৃষি দফতরের ওই কর্তার দাবি, আলু অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মেনেই তার মজুতদারি নিয়ন্ত্রণ করছে রাজ্য সরকার।
মজুতদারির শাস্তি এড়াতে স্বনামে যে আলু মজুত রাখেন না, সে কথা অস্বীকার করছেন না ব্যবসায়ীরাও। তাঁদের একজন বলেন, “ঝামেলা এড়াতে স্ত্রী, বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির নামে তো আলু রেখেইছি, সঙ্গে গাড়ির দুই চালকের নামেও ৮০০ মেট্রিক টন আলু রাখতে হয়েছিল।” এত দিন তা সম্ভব হয়েছে, কারণ হিমঘর মালিকের কাছে কোনও নথিপত্র জমা না দিয়েই আলু বন্ড নেওয়া যেত। এ বছর সরকারি বিজ্ঞপ্তির ফলে ভোটার কার্ড দিয়ে তবেই বন্ড কেনা যাবে। বেনামি বন্ড বিক্রি করা হিমঘর মালিকের কাছেও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ব্যবসায়ী ও হিমঘর মালিক, দু’পক্ষই সমস্যায় পড়েছে।
হিমঘর মালিকদের সংগঠনের রাজ্য সভাপতি রামপদ পালের কথায়, “আলুর সংরক্ষণকে কোনও সীমার মধ্যে আটকে না রেখে রাজ্য সরকারের কাছে আমরা এই বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়েছি।” ব্যবসায়ীদেরও অভিযোগ, বাজারকে বেসামাল করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। তাঁদের যুক্তি, রাজ্যে গত বছর প্রায় ৯৫ লক্ষ মেট্রিক টন আলু চাষ হয়েছিল। রাজ্যে যা হিমঘর রয়েছে তাতে ৬০-৬২ লক্ষ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। অতিরিক্ত আলু বিক্রি করেন, কিংবা ভিন রাজ্যে সংরক্ষণ করেন ব্যবসায়ীরা। যেহেতু এই রাজ্যের বেশির ভাগ চাষিই কম জমি (দুই থেকে চার বিঘে) মালিক, তাঁদের হাতে ব্যবসা বা সংরক্ষণ করার মতো মূলধন থাকে না। তাঁরা চাষের ঋণ পরিশোধ এবং পরবর্তী চাষের খরচ জোটাতে চটজলদি ফসল বিক্রি করতে চান। ব্যবসায়ীরাই তা কিনে নিয়ে সংরক্ষণ করেন। বাজার ওঠা-পড়ার ঝুঁকিও তাঁরাই বহন করেন। এখন ব্যবসায়ীদের ‘মধ্যসত্ত্বভোগী’ বলে সরকার সরিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু প্রায় নয় মাস হিমঘরে আলু মজুত রাখার মতো আর্থিক সঙ্গতি চাষির আছে কি না, সরকার তা দেখছে না।
ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ব্যবসায়ীদের সংরক্ষণের পরিমাণ জোর করে কমিয়ে দিলেও, তাঁদের জায়গা নিতে পারবেন না চাষিরা। বরং ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে যাবেন বলে আশঙ্কা। এক দিকে হিমঘর ফাঁকা থেকে যাবে। অন্য দিকে, চাষি আলুর দাম পাবেন না।
অন্য দিকে সরকারের যুক্তি, গুটিকয় ব্যবসায়ীর হাতে রাজ্যের এই বৃহত্ পরিমাণ আলুর লাগাম থাকে বলেই তাঁদের খুশি মতো আলুর দাম ওঠা নামা করে। তা রুখতেই এই বিজ্ঞপ্তি। এ বার চাষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও হিমঘরে আলু রাখবেন। তাতে চাষিরও লাভ, ক্রেতারও লাভ। এক সরকারি কর্তার কথায়, “বিভিন্ন বৈঠকে ব্যবসায়ী ও হিমঘর মালিকেরা তো জানিয়েছেন, তাঁরা নাকি হিমঘরে বেশি আলু রাখেন না। যা আলু থাকে তা চাষিরই আলু। তাহলে সমস্যা হবে কেন?’’ সরকারের যুক্তি, কাউকে বেআইনি কিছু করতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া যায় না। তবু ব্যবসায়ীরা যদি তাঁদের প্রকৃত চাহিদা জানান, তাহলে তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
এক দিকে ক্ষতির মুখে আলুচাষির ক্ষোভ, অন্য দিকে আলু দাম বাড়লে ক্রেতার রোষ। এই উভয় সঙ্কটের মুখে কী করবে রাজ্য, এখন তাই দেখার।