তালা বন্ধ ঝাড়গ্রাম মহকুমা পর্যটন তথ্য কেন্দ্র (বাঁ দিকে)। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আগাছাময় শহরের রবীন্দ্র পার্ক (ডান দিকে)। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
কথায় আছে, বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। চল্লিশের দশক থেকে ছুটি পেলেই বাঙালির ঘোরার অন্যতম জায়গা হয়ে ওঠে ঝাড়গ্রাম। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে মাওবাদী নাশকতার ঘটনা শুরু হওয়ার পরে পর্যটকদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ঝাড়গ্রামের বেশ কয়েকটি অতিথিশালা ও হোটেলের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাজ্যে পালা বদলের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফের পর্যটকরা ঝাড়গ্রামমুখী হচ্ছেন। কিন্তু ভরা মরসুমে ঝাড়গ্রাম শহরে পর্যটকদের থাকার মতো হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র অতিথিশালা বা লজ-হোটেল রয়েছে। পর্যটকদের জন্য সরকারি অতিথিশালাও রয়েছে মাত্র একটি। মল্লদেব রাজপ্রাসাদে আধা সরকারি অতিথিশালা রয়েছে।
ঝাড়গ্রাম রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে ঝাড়গ্রাম ট্যুরিজম সার্কিট গড়ে তোলার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রাসাদের বাসিন্দা তথা মল্ল-উগাল-ষণ্ডদেব রাজ বংশের উত্তর পুরুষ দুর্গেশ মল্লদেব হলেন ঝাড়গ্রামের পুরপ্রধান। অথচ এখনও অরণ্যশহরে পর্যটন পরিকাঠামোর হাল ফেরেনি। অভিযোগ উঠছে, ঝাড়গ্রাম পুরসভার পক্ষ থেকেও কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হয়নি। বাম আমলে ২০০০ সালে ঝাড়গ্রাম পুরসভার উদ্যোগে শহরের কদমকানন এলাকায় ‘বনানী অতিথি নিবাস’টি চালু হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ সালে মাওবাদী অশান্তিপর্বে রাজ্যের তৎকালীন বাম সরকার বনানী অতিথি নিবাসে সিআরপি ক্যাম্প করার অনুমতি দেন। পর্যটকদের থাকার জায়গাটি এখন সিআরপি’র ১৮৪ নম্বর ব্যাটালিয়নের হেড কোয়ার্টার! তৃণমূলের বর্তমান পুরবোর্ড পর্যটকদের জন্য নতুন কোনও অতিথিশালা তৈরির ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি।
অরণ্যশহরে পর্যটকদের থাকার জন্য ঝাড়গ্রাম রাজপ্রাসাদে রয়েছে অতিথিশালা। এটি রাজ পরিবার ও পর্যটন দফতরের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়। সেখানে সব মিলিয়ে ৫০ জন থাকতে পারেন। গত বছর শহরের উপকন্ঠে বাঁদরভুলা জঙ্গলের মধ্যে একটি প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি লজ-হোটেল রয়েছে। তবে সেগুলি মূলত, জনবহুল এলাকার মধ্যে। ঝাড়গ্রাম হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন কর্মকার বলেন, “অরণ্যশহরে ১৪টি লজ-হোটেল থাকলেও পর্যটকদের থাকার উপযোগী মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি জায়গা রয়েছে। তাতে মেরেকেটে দু’শো জন পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা হতে পারে।” তবে বর্তমানে ঝাড়গ্রাম রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স তৈরির কাজ জোর কদমে এগোচ্ছে।
তবে ঝাড়গ্রাম শহরে পুরসভার তত্ত্বাবধানে থাকা রবীন্দ্রপার্কটির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। আগের বাম পুরবোর্ডের আমল থেকেই পার্কের ভিতর খাবার হোটেল চলছে। পুরসভার অন্য পার্কগুলির অবস্থাও তথৈবচ। এসডিও অফিসের উল্টোদিকের বৈকালিক পার্কটিরও ভুতুড়ে দশা। লোকাল বোর্ড এলাকার সঞ্চয়িতা পার্কের জলাশয়ে বোটিং বন্ধ রয়েছে। শহরে ভাড়ার গাড়ির নির্দিষ্ট কোনও দর-তালিকা নেই। ভাড়ার গাড়ির চালকেরা যে যেমন খুশি ভাড়া নেন। অরণ্যশহরে বেড়াতে আসা কলকাতার সঞ্চয়িতা প্রামাণিক, হুগলির শ্রীরামপুরের তেজময় মণ্ডল, রেখা মণ্ডলদের অভিযোগ, “এই শহরে ভাড়ার গাড়ি যেমন খুশি দর হাঁকে। শহরে রিকশা ভাড়াও অসম্ভব বেশি।” রেল স্টেশন থেকে রাজপ্রাসাদের রিসর্ট কিংবা বাঁদরভুলায় প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। ফলে সমস্যায় পড়েন পর্যটকেরা।
শহরে নেই-এর তালিকাটি আরও দীর্ঘ। ঝাড়গ্রাম শহরে পর্যটকদের জন্য কোনও ট্যুরিস্ট গাইড ম্যাপ নেই। নেই স্থানীয় হস্তশিল্পের কোনও স্টল বা বাজারও। পুরবোর্ডের ক্ষমতায় তৃণমূল আসার পরে পর্যটন তথ্য কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঝাড়গ্রাম পুর নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক তপন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “আগের পুরবোর্ড শহরে সুনির্দিষ্ট পর্যটন পরিকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয় নি। বর্তমান পুরবোর্ডও এ ব্যাপারে কিছু ভাবছে না। দিনে দিনে ঝাড়গ্রাম শহর অপরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। শহর সাজানোরও কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।”
২০০৩ সাল থেকে নিজস্ব উদ্যোগে ঝাড়গ্রামের পর্যটন প্রসারে কাজ করে চলেছেন অরণ্যশহরের বাসিন্দা সুমিত দত্ত। ঝাড়গ্রামের পর্যটন নিয়ে ইংরেজির পাশাপাশি, বাংলা-সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় একটি ওয়েব সাইটও চালু করেছেন তিনি। সুমিতের দাবি, “শহরের পর্যটন প্রসারের জন্য পর্যটন দফতরে এক গুচ্ছ প্রস্তাব পাঠিয়েছি। পুরসভাকেও অনুরোধ করেছি।” ঝাড়গ্রামের পুরপ্রধান দুর্গেশ মল্লদেব বলেন, “জঙ্গলমহল মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় জায়গা। রাজ্য সরকার ঝাড়গ্রামের পর্যটন প্রসারে নানা পদক্ষেপ করছে। শহরের পর্যটন পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য পুরসভার তরফেও সাধ্যমত পদক্ষেপ করা হবে।”
সেই উদ্যোগ কবে বাস্তবায়িত হয়, এখন সেটাই দেখার!