মোট ভোটার প্রায় ২ লক্ষ। এর মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ তরুণ প্রজন্মের, যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৯। রেলশহর খড়্গপুরে এই তরুণ প্রজন্মের ভোটকেই ‘পাখির চোখ’ করেছে সব দল। তরুণদের ভোট নিশ্চিত করতে তারা প্রচার চালিয়েছে বলেও দাবি রাজনৈতিক দলগুলো।
খড়্গপুরে মোট ভোটার ২,১০,৪০২। এর মধ্যে ১৮-১৯ বয়সী ৪,৫০৫ জন। ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৪৫,৪৫৭ জন। ৩০-৩৯ বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৪৯,১৯৩। ৪০-৪৯ বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৪৬,৭১৩। অন্যদিকে, ৫০- ৫৯ বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৩৩,৭৭৯। ৬০-৬৯ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ১৮,৯৩২। ৭০- ৭৯ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৮,৮৭১ এবং ৮০ এবং এর বেশি বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ২,৯৫২।
রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পিছনে যে তরুণ প্রজন্মের সমর্থন হারানো অন্যতম কারণ তা মানে বামেরা। অন্য দিকে, গত লোকসভা ভোটে তরুণ প্রজন্মের একটা ভাল অংশের সমর্থন চলে গিয়েছে বিজেপি-র দিকে। পুরসভার ভোটেও যে তরুণ প্রজন্মের ভোট গুরুত্বপূর্ণ তা মানছে সব দলই। সিপিআইয়ের জেলা সহ-সম্পাদক বিপ্লব ভট্ট বলছেন, ‘‘এক সময় তরুণ প্রজন্মের সমর্থন আমরা পাইনি। তবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে।’’
তাঁর কথায়, ‘‘কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের উদ্যোগ কোথায়? আগে ভিন্ রাজ্য থেকে চাকরি করতে অনেকে পশ্চিমঙ্গে এলেও এখন ছবিটা পুরোপুরি উল্টো। যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘তরুণ প্রজন্মের সমর্থন আমাদের দিকেই আছে। যুবক যুবতীরা বুঝতে পারছেন, এ রাজ্যে বিজেপি-ই বিকল্প। আমরা ক্ষমতায় এলেই কাজের সুযোগ বাড়তে পারে।’’ খড়্গপুর শহর কংগ্রেস সভাপতি অমল দাসের বক্তব্য, ‘‘এ বারও তরুণ প্রজন্মের ভোট কংগ্রেসই পাবে।’’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় অবশ্য বলছেন, ‘‘লোকসভা আর পুরসভার ভোট এক নয়। লোকসভায় যাঁরা বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিলেন, এই সময়ের মধ্যে তাঁদের ভুল ভেঙেছে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘রাজ্য আর্থিক সমস্যার মধ্যে আছে। তাও উন্নয়ন- কর্মসংস্থান হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের সমর্থন তৃণমূলের দিকেই আছে।”
আজ, শনিবার পশ্চিম মেদিনীপুরের ৬টি পুরসভায় নির্বাচন। এর মধ্যে অন্যতম খড়্গপুর। রেলশহর কংগ্রেসের গড় বলেই পরিচিত। কংগ্রেসের গড়ে সম্মানের লড়াইয়ে জিততে তৃণমূল ভোট লুঠের ছক করেছে বলেও অভিযোগ। কংগ্রেস কর্মীদের বক্তব্য, এখানে তাদের দাপট মোকাবিলা করা যে খুব সহজ নয়, তা বুঝতে পারছে তৃণমূল। তাই ‘অন্য পথে’ জয় নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
কী সেই পথ? শহর কংগ্রেসের অভিযোগ, পুলিশি মদতে সন্ত্রাসের ছক তৈরি করেছে তৃণমূল। ভোটের দিন গোলমাল করে ভয় দেখিয়ে তাদের কর্মীদের বুথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সমস্ত কৌশলই নিতে পারে শাসক দলের লোকজন। কলকাতা মডেলে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখারও পরিকল্পনা করা হয়েছে। শাসক দলের সন্ত্রাস দেখেও না-দেখতে পারেন পুলিশ-কর্তারা। ইতিমধ্যে রেলশহরে তৃণমূল আশ্রিত ছোট-বড় দুষ্কৃতীরা ঢুকে পড়েছে বলে অভিযোগ। কেন ‘অন্য পথে’ জয় নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হচ্ছে শাসক দলকে?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এর পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এক, গত লোকসভার নিরিখে রেলশহরে বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছে বিজেপি। ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯টিতে এগিয়ে আছে পদ্ম-শিবির। দুই, গত পুরভোটে একক ভাবে তৃণমূল বেশি আসন (১৫টি) পেলেও প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে এগিয়ে ছিল কংগ্রেসই (১২টি আসন পেয়েও)। এটা শাসক দলের নেতৃত্বের অজানা নয়। তিন, গত পুরভোটে ৭টি আসনে কম ব্যবধানে জেতেন তৃণমূল প্রার্থীরা। ১ নম্বরে ৪৯ ভোটের ব্যবধানে, ৫ নম্বরে ১৯৯, ১৬ নম্বরে ৪৬, ২৬ নম্বরে ৯৬, ২৮ নম্বরে ২০৯, ৩৩ নম্বরে ২৩ এবং ৩৫ নম্বরে ১৩২ ভোটের ব্যবধান ছিল।
কেন তরুণ প্রজন্মের সমর্থন তৃণমূলের দিকে নেই বলে দাবি করছে বিরোধীরা? বিরোধীদের বক্তব্য, রাজ্যে পালাবদলের পর নতুন কারখানা তো সেই ভাবে হয়নি। উল্টে একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ হয়েছে। বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। শিক্ষিত বেকাররাও অস্থায়ী কাজ খুঁজছেন। তাদের দাবি, রাজ্য সরকারের শিল্পনীতির জন্যই একদিকে যেমন নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে তেমন হাজার হাজার কর্মরত শ্রমিক রুজিরুটি হারাচ্ছেন। শহর ঘেঁষা খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকায় বহু জমি পড়ে আছে। শিল্পের দেখা নেই। খড়্গপুরের বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকে ১,২৪৯ একর জমি আছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০৫ একর জমি ব্যবহৃত হয়েছে। বাকি ৯৪৪ একর ফাঁকা পড়ে আছে। বাম-আমলে সরকার এখানে জমি অধিগ্রহণ করেছিল শিল্পের জন্য। তৃণমূল সরকারের শিল্প গড়ার উদ্যোগই নেই। এ সবের প্রভাব তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।
খড়্গপুরে ২৬৫টি বুথ রয়েছে। ১১৬টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে। এর মধ্যে ৪২টি কেন্দ্র ‘স্পর্শকাতর’। এই ‘স্পর্শকাতর’ কেন্দ্রগুলো রয়েছে দেবলপুর, ইন্দা, মালঞ্চ, ভগবানপুর, পুরাতনবাজার, রবীন্দ্রপল্লি, হিজলি, মথুরাকাটি এলাকায়। কেন তরুণ প্রজন্মের ভোটকেই ‘পাখির চোখ’ করা? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সময়ের সঙ্গে নতুন আশা-আকাঙ্খা জন্ম নিচ্ছে। আর যে ধরাবাঁধা গতে চললে হবে না, কিছুটা দেরিতে হলেও তা বুঝতে পারছে রাজনৈতিক দলগুলো।