অশক্ত শরীরেই মিষ্টি বানাচ্ছেন পরেশ বেরা। নিজস্ব চিত্র।
বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দই বিক্রি করতেন। কিন্তু ছোট থেকেই নাটকের প্রতি অমোঘ টান। তখন থেকে নাটকের মঞ্চ মাতিয়েছেন। আজ বার্ধক্যে পৌঁছে শিল্পী একেবারেই অসহায়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে কুঁজো হয়ে গিয়েছেন। সেই অবস্থাতেই চলছে হাঁটাচলা। তবে এই ৯৩ বছরেও শিল্পীর ঠোঁটস্থ নাটকের সমস্ত ডায়ালগ। তবে তা দিয়ে আর পেট ভরার উপায় নেই। রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানানোয় নাট্যকর্মী হিসাবে ভাতার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু তাও প্রায় দু’বছর ধরে বন্ধ। সংসার চালাতে তাই এখনও দোকানে মিষ্টি বিক্রি করেন। সরকারের কাছে তাঁর একটাই আর্জি, ফের যেন ভাতা চালু করা হয়।
পটাশপুরের বাগমারি গ্রামে জন্ম পরেশ বেরার। এলাকার লোক চেনেন ‘মাস্টারমশাই’ নামে। ছোট থেকে অভাবী সংসারে বাবার সঙ্গে দই তৈরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করতেন। সঙ্গে চলত টিকরাপাড়া স্কুলে পড়াশোনা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিক্ষকদের সঙ্গে প্রথম কালকেতু-ফুল্লরা নাটকে ছদ্মবেশী বিশুর চরিত্রে অভিনয় দিয়ে হাতেখড়ি। সাংসারিক অভাব আর নাটকের টানে নবম শ্রেণির পর আর পড়া এগোয়নি। রাতে নাটক আর দিনে দইয়ের ব্যবসা চলত। বাবার মৃত্যুর পরে সংসার সামলাতে ব্যবসায় জোর দিতে হয়। নিজের দশ ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে তাদের মানুষ করার পাশাপাশি নাটকে অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন। একটা সময়ে নাটকের নেশায় মাসের পর মাস বাড়ির বাইরে রাত কাটাতেন পরেশ। বাড়িতে স্ত্রী একা ছেলেমেয়েদের সামলাতেন।
নাটকে অভিনয় করার পাশাপাশি নির্দেশনার কাজও করেছেন। জীবনের সেরা নাটক হরিশচন্দ্র-শৈব্যা। বাগমারি শ্রী কল্যাণ সংঘ থিয়েটারের সঙ্গে পথচলা শুরু। এখন সেই সংঘের কোনও অস্তিত্ব নেই। তবে শতাধিক নাটক ও থিয়েটারে অভিনয়ের সঙ্গে নির্দেশনার কাজ করেছেন পরেশ। ছিয়াত্তর বছর বয়সে ‘শেষ উত্তর’ নাটকে মঞ্চে শেষ অভিনয়। তবে নির্দেশনার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর হাতে গড়া অনেক ছাত্র এখন যাত্রা ও নাটকের শিল্পী। প্রতাপদিঘি বাজারে নিজের মিষ্টির দোকান চালান।
২০১৯ সালে সরকারি ভাবে নাট্যকর্মীদের জন্য ভাতা চালু হয়েছিল। প্রথম দু’বছর ভাতা পেয়েছেন পরেশ। তারপর থেকে আর ভাতা পাননি বলে দাবি নাট্যশিল্পীর। ভাতা বন্ধ থাকায় শারীরিক অক্ষমতার মধ্যেও কোনওরকমে টিকিয়ে রেখেছেন মিষ্টির দোকান। ছাত্ররা এসে এখনও ‘মাস্টারমশাই’-এর খোঁজখবর নিয়ে যায়। ভাঙা গলায় এখনও অনর্গল বলে যেতে পারেন নাটকের ডায়ালগ। যা শুনে আজও মুগ্ধ হন প্রতিবেশীরা।
পরেশবাবুর বড় ছেলে সুভাষ বেরা জানান, বাবার নাটকের প্রতি খুব নেশা। এমন হয়েছে, কয়েক মাস বাড়িই আসেননি। এই বয়সেও নিজে হাতে সবকাজ করেন। ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওঁর খুব অসুবিধা হচ্ছে। আর শিল্পীর কথায় ‘‘গত দুবছর ভাতা পেয়েছিলাম। এক বছর আর ভাতা পাইনি। নিজের অসুস্থতা চিকিৎসার জন্য টাকাটা ভীষণ দরকার। সরকার ভাতা দিলে আমার উপকার হত।’’ এ বিষয়ে এগরার মহকুমা শাসক সম্রাট মণ্ডল বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। দ্রুত খোঁজ নিয়ে ফের যাতে ওঁর ভাতা চালু করা যায় তার ব্যবস্থা করা হবে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।