ডাকঘরের কাউন্টারে লম্বা লাইন গ্রাহকদের। ছবি: সোহম গুহ।
জরাগ্রস্ত কাঁথি মুখ্য ডাকঘর। সামান্য কাজেও সময় লাগছে বিস্তর। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও কাজ না হওয়ায় বিরক্ত হয়ে ফিরেও যাচ্ছেন অনেক গ্রাহক।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এনএসসি প্রকল্পের টাকা তোলার জন্য কাঁথি ডাকঘরে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলেন বাদলপুর জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক রামগোবিন্দ পানিগ্রাহী। আট দিন পরেও ডাকঘর থেকে সেভিংস অ্যাকাউন্টের পাস বই পাননি তিনি। ফলে রামগোবিন্দবাবু এনএসসি-র টাকাও তুলতে পারছেন না।
কাঁথি শহরের বাসিন্দা রামগোবিন্দবাবুর অভিযোগ, “ডাকঘর থেকে সেভিংস অ্যাকাউন্ট হয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে। যদিও তাঁকে কোনও পাস বই দেওয়া হয়নি। ফলে পাস বইয়ের অভাবে তিনি টাকা তুলতে পারছেন না। পাস বই পেতে যেখানে একদিন বা বড়জোর দু’দিন সময় লাগার কথা, সেই কাজ আটদিনেও হয়নি।’’
পাসবইয়ের খোঁজে ডাকঘরে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান রামগোবিন্দবাবু বলছেন, ‘‘পারিবারিক প্রয়োজনে টাকার খুব দরকার ছিল। টাকা না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় কাজটা বোধহয় হবেই না। এখন কী যে হবে কিছুই বুঝতে পারছিনা।’’
শুধু রামগোবিন্দবাবু নন, কাঁথি মুখ্য ডাকঘরের অধিকাংশ গ্রাহকরেই অভিযোগ, ডাকঘরে কর্মীসংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে যে কোনও কাজই চলে শ্লথ গতিতে। আধুনিকীকরনের জন্য গতবছর ডাকঘরে ‘কোর বাঙ্কিং সিস্টেম’ (সিবিএস) চালু করা হয়। যদিও সিবিএস চালু হয়েছে নামেই, আদতে পরিষেবার হাল ফেরেনি বলে অভিযোগ একাংশ গ্রাহকের।
ডাকঘরের গ্রাহক ও স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের এজেন্টদের অভিযোগ, “দিনের অধিকাংশ সময় লিঙ্ক না থাকায় ডাকঘরের যাবতীয় কাজকর্ম অচল হয়ে পড়ছে। আবার দীর্ঘসময় পর লিঙ্ক ফিরলেও গতি অনেক কম থাকে। ফলে সামান্য কাজ করতেও অনেকটা সময় লেগে যায়।’’ ডাকবিভাগের কাঁথি ডিভিশনের সবচেয়ে বড় কাঁথি মুখ্য ডাকঘরে গড়ে প্রতিদিন হাজার তিনেক গ্রাহক নানা কাজে আসেন। এ ছাড়াও স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের এজেন্টরাও গ্রাহকদের টাকা জমা দিতে আসেন ডাকঘরে।
আর কর্মী সঙ্কটের কথা তো বলাই বাহুল্য। কোথাও একজন তো কোথাও দু’জন কর্মী নিয়েই কোনও মতে ধুঁকছে উপ-ডাকঘরগুলি। কাঁথি ডাকঘরের গ্রাহক বহিত্রকুণ্ডা গ্রামের উজ্জ্বল পণ্ডা ও দইসাই গ্রামের তাপস পয়ড়্যার অভিযোগ, “ডাকঘরে এসে টাকা তুলতে বা জমা দিতে এত সময় চলে যায় যে ডাকঘরে গেলে সে দিন আর অন্য কোন কাজ করা যায় না। ফলে আমাদের মতো ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের সমস্যার মুখে পড়তে হয়।” জমা টাকা সময় মতো তুলতে না পারলে গ্রাহকেরা কেন ডাকঘরমুখী হবেন, সেই প্রশ্নও তুলছেন তাপসবাবু।
ডাক বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, কাঁথি ডিভিশনে কাঁথি মুখ্য ডাকঘর ছাড়াও ৫০টি উপ ডাকঘর ও ৪২৯টি শাখা ডাকঘর রয়েছে। এরমধ্যে কাঁথি মুখ্য ডাকঘর ও ১৯টি উপ ডাকঘরে সিবিএস চালু হয়েছে। অধিকাংশ উপ-ডাকঘরগুলিতেও দিনের বেশির ভাগ সময় লিঙ্ক থাকে না বলে অভিযোগ। উপ-ডাকঘরগুলির কর্মীদের অভিযোগ, উপ ডাকঘরগুলিতে কোর ব্যাঙ্কিং চালানোর জন্য কম্পিউটার, প্রিন্টার-সহ অন্যান্য যে সব যন্ত্রসামগ্রী দেওয়া হয়েছে সেগুলি নিম্নমানের। ফলে একটু কাজের চাপ বাড়লেই কম্পিউটার বিকল হয়ে পড়ছে। প্রিন্টারগুলি থেকেও ছাপা কাগজ স্পষ্ট নয়। কাঁথি মুখ্য ডাকঘরে টাকার নোট গোনা ও জাল টাকা শনাক্তকরণের জন্য নামমাত্র একটি মেশিন রয়েছে। যদিও উপ-ডাকঘরগুলিতে তাও নেই। ফলে টাকা গুনতে দেরি তো হচ্ছেই। একইসঙ্গে মাঝে-মধ্যে বেশ কিছু জাল নোট জমা পড়ার খেসারত হিসেবে ডাককর্মীদের নিজেদের পকেট থেকেই টাকা দিতে হচ্ছে।
ডাকঘরের এক এজেন্টের কথায়, ‘‘প্রতিদিন ডাকঘরের বিভিন্ন প্রকল্পের জমা দেওয়ার জন্য গ্রাহকদের সাক্ষর করা ৫-১০টি ফর্ম ও টাকা নিয়ে যাই। যদিও গড়ে দু’টোর বেশি ফর্ম জমা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে গ্রাহকদের জমা প্রকল্পের ফর্ম জমা দিতেই ৩-৪ দিন সময় লেগে যাচ্ছে।’’ তিনি বলছেন, ‘‘দীর্ঘদিনের অচলাবস্থায় বিরক্ত হয়ে অনেক গ্রাহক ডাকঘর থেকে অ্যাকাউন্ট সরিয়েও নিচ্ছেন।’’
ডাকঘরের জীর্ণ দশা ঘুচবে কবে, তা অবশ্য বলবে সময়ই।