কটূক্তি আর বাঁকা চাহনি সহ্য করেই পথ চলা। গিরিময়দানের কাছে নিমপুরা রোডে।ছবি- রামপ্রসাদ সাউ
“এই যে মামুনি আমরা এখানে। চলো প্রেমবাজারে যাই। বাইক একেবারে রেডি।...”
স্কুল ছুটির পরে গেটের সামনে দাঁড়ানো এক কিশোরীকে অবলীলায় কথাগুলো বলছিল বাইক আরোহী এক যুবক। ইন্ধন জোগাচ্ছিল তার বন্ধুরা। খানিক বাদে সজোরে সিটি। এ সব দেখে-শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল স্কুলপোশাকের মেয়েটি।
ভরদুপুরে রেলশহরের রাস্তায় এমন দৃশ্য হাঁ করে দেখলেন অনেকেই। কিন্তু কোনও প্রতিবাদী স্বর শোনা গেল না। ছলছলে চোখে মুখ নীচু করে বাড়ি ফিরল মেয়েটি।
ইভটিজিংয়ের এমন ঘটনা অহরহ ঘটে খড়্গপুরে। শুধু অল্পবয়সী মেয়েরা নয়, পথে বেরিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন গৃহবধূরাও। প্রতিবাদ করলে গালি, চোখরাঙানি এমনকী মারধরের মুখে পড়তে হচ্ছে। পুলিশে অভিযোগ জানালেও সুবিচার মিলছে নান। বরং বিপদ আরও বাড়ার আশঙ্কা থাকে। আর এই সুযোগে মালঞ্চ, ইন্দা, সুভাষপল্লি, খরিদা, গোলবাজার, নিউ সেটলমেন্টের স্কুল-কলেজ, বাজার এলাকায় বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অল্পবয়সী ছেলেরা। এরা ‘বাইক রোমিও’ বলেই পরিচিত। রাতে আবার এদের অধিকাংশই মদ্যপ অবস্থায় পথচলতি মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। সব মিলিয়ে প্রশ্নের মুখে মেয়েদের নিরাপত্তা।
অপরাধের অন্ধকার দুনিয়া খড়্গপুরবাসীর অচেনা নয়। এক সময় রেল মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য দেখেছে এই শহর। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত খুন, গুলির লড়াই ছিল রোজকার ঘটনা। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। তবে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হুমকি, মারধর, ছিনতাইয়ের ঘটনা হামেশাই ঘটে। গুলি চলা বা খুনের ঘটনাও ঘটে। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা আর শাসক দলের আশ্রয়ে এই সব দুষ্কৃতীদের দাপট বাড়ে বলে অভিযোগ। যে সব যুবক ইভটিজিংয়ে যুক্ত তাদের বেশিরভাগই দুষ্কৃতী দলের ঘনিষ্ঠ। ফলে, তাদের আচার-আচরণে বেপরোয়া ভাব স্পষ্ট।
এই যুবকদের অধিকাংশের হাতেই রয়েছে মোটরবাইক। আর তাতে চেপে স্কুল-কলেজের পথে ছাত্রী অথবা শপিং মলে যাওয়া বিবাহিত তরুণীকে উত্ত্যক্ত করাই এদের অবসর-বিনোদন। ইন্দার বিদ্যাসাগরপুরের যুবতী শ্রীতমা গুপ্তের অভিজ্ঞতা, “রাত ন’টার পরে গোলবাজারের মতো ব্যস্ত এলাকাও এত ফাঁকা হয়ে যায় যে পথে বেরোলে আতঙ্কে থাকি। বাইকে আরোহী যুবকেরা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে। কিছু বলতে গেলে পরিস্থিতি জটিল হয়।’’ শ্রীতমার অভিযোগ, পুলিশের টহল না থাকে না বলেই এই পরিস্থিতি। শহরের মেয়েরা নিরাপদে নেই। এ বার পুলিশের ভাবার সময় এসেছে।
এক সময় এই শহরে পড়াশোনা করেছেন ঝাপেটাপুরের গৃহবধূ নমিতা সরকার, বুলবুলচটির স্বাতী বেরা। এখন তাঁদের মেয়েরা পড়াশোনা করছে। কিন্তু চেনা শহরের পরিবেশ এখন অচেনা ঠেকে বছর সতেরো আগে স্কুলের গণ্ডি পেরোনো এই মায়েদের। নমিতার কথায়, “আমারা রাত করে টিউশন থেকে নির্বিঘ্নেই ফিরতাম। কিন্তু এখন মেয়ে টিউশনে গেলে উদ্বেগে থাকি। পাঁচ বছর আগেও তো শহরটা এমন ছিল না।” একই সুরে স্বাতী বলেন, “ভালবেসে বিয়ে করেছি। স্কুল-কলেজে অনেক প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছি। কিন্তু অসভ্যতা করেনি কেউ। এখন ছেলেরা সব বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মেয়েকে সন্ধের পরে একা বাইরে ছাড়ার কথা ভাবতেই পারি না।’’
এক সময় গোলবাজার সংলগ্ন রেলের উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে অল্পবয়সী ছেলেছোকরারা ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত। চিঠিতে প্রেমের প্রস্তাব বা মোবাইল নম্বর জোগাড়ে ব্যাকুলতাও দেখা যেত। কিন্তু তাদের আচরণ সে ভাবে শালীনতার সীমা অতিক্রম করত না। এখন অবশ্য পরিস্থিতি একেবারে উল্টো। শহরের নানা এলাকায় আকছার ইভটিজিং ঘটছে। খরিদা-মালঞ্চ এলাকায় এই সমস্যা বেশি। এখানকার হিতকারিণী হাইস্কুলের সামনে যুবকদের উৎপাত রোজকার ঘটনা। কখনও প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কখনও নিছক মজার জন্য ইভজিটিং চলছে। আর লাঞ্ছিত-অপমানিত হচ্ছে ছাত্রীরা। গত বছর ৪ ফেব্রুয়ারি ছত্তীসপাড়ার বাড়িতে ফেরার পথে ওই স্কুলেরই নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে প্রকাশ্য রাস্তায় মুখে রুমাল চাপা দিয়ে শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল। ছাত্রীটির দাদার প্রতি বদলা নিতেই ছিল ওই আক্রমণ। ঘটনায় খরিদা গেটের বাসিন্দা রাজু পাণ্ডা ও বিজু পাণ্ডার নামে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। গত বছর জুনে সাদা পোশাকের মহিলা পুলিশ দিয়ে হিতকারিণী স্কুলের বাইরে ফাঁদ পাতে টাউন থানা। কয়েকজনকে পাকড়াও করে পুলিশ। পরে অবশ্য স্থানীয় কিছু নেতার হস্তক্ষেপে সকলেই ছাড়া পেয়ে যায়।
পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা আর শাসক দলের এই প্রশ্রয়ে ইভটিজিংয়ে তাই দাঁড়ি টানা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রীর কথায়, “প্রতিদিন স্কুল থেকে বাইরে যেতেই গলির মধ্যে যুবকেরা নানা কুকথা বলে। স্কুল শুরু ও ছুটির সময়ে পুলিশ টহল থাকলে ভাল হয়।” শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একাধিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রীদের অভিজ্ঞতাও বিশেষ আলাদা নয়।
শুধু স্কুল কেন শপিং মল, বাজার এলাকাতেও একই সমস্যা। নিউ সেটলমেন্টের শপিং মলমুখী রাস্তায় তো ‘বাইক রোমিও’দের উৎপাতে আতঙ্কে থাকে মেয়েরা। আইআইটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী অমিশা যাদব, একাদশ শ্রেণির সিমরন কৌরের অভিজ্ঞতা, “আমরা হাল ফ্যাশনের পোশাক পড়ি। আর সে সব পরে রাস্তায় বেরোলে ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বাজে মন্তব্য করে। ভয়ে ভয়েই পথ চলি।’’ এঁদের সকলেরই অভিযোগ, পুলিশকে সব সময় পথে দেখা যায় না।
ভুক্তভোগী সকলেই পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেও পুলিশের দাবি, শহরে যথেষ্ট টহলদারি চলে এবং ইভটিজিংয়ের ঘটনা সে ভাবে নজরে আসে না। আর যেকটা অভিযোগ আসে, তখনই পদক্ষেপ করা হয়। ইভটিজিংয়ের ঘটনায় সাধারণত ‘নন কগনিজেবল রিপোর্ট’ (এনসিআর) দিতে হয়। এতে সহজেই জামিন পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। তবে কোনও মহিলা শ্লীলতাহানির অভিযোগ করলে মামলা জোরালো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ মহিলাই ঝামেলায় জড়াতে চান না। যদিও ২০১৫ সালে খড়্গপুর টাউন থানা এলাকায় ৭৮টি শ্লীলতাহানির মামলা দায়ের হয়েছিল বলে পুলিশ সূত্রে খবর। অবশ্য তাতেও ইভটিজিংয়ে দাঁড়ি টানা যায়নি।
তাই শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ বাইক রোমিওদের দৌরাত্ম্য চলছেই। লজ্জায় কুঁকড়ে পথচলাটা তাই গা সওয়া করে নিতে হচ্ছে খড়্গপুরের মেয়েদের!