—ফাইল চিত্র।
‘জাস্টিস ফর আর জি কর’- এই মূল দাবি রাজনীতির আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে না তো? নবান্ন অভিযানে ধুন্ধুমার, তারপর বাংলা বনধ, এ সব ঘটনাক্রমে সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
আর জি করে খুন-ধর্ষণের বিচার চেয়ে রাজ্য জুড়েই নাগরিক প্রতিবাদ হচ্ছে। এর শুরুটা হয়েছিল মেয়েদের উদ্যোগে সামাজিক ছকভাঙা নৈশ প্রতিবাদের মাধ্যমে। মেদিনীপুরে রাত দখলের কর্মসূচিতে শামিল হয়েছিলেন লেখিকা-সমাজকর্মী রোশেনারা খান। রোশেনারা বলছেন, ‘‘আর জি কর কাণ্ডে ন্যায়বিচার, এটাই তো মূল বিষয়। এখন রাজনৈতিক নেতারা পথে নেমে পড়েছেন। আজ এই দল নামলে, কাল অন্য দল পাল্টা পথে নামছে। রাজনীতির আবর্তে মূল বিষয়টি হারিয়ে না যায়!’’
বুধবার বাংলা বন্ধ ডেকেছিল বিজেপি। মেদিনীপুরেও পথে ছিল যুযুধান দুই দল। বন্ধের সমর্থনে বিজেপির মিছিল ‘আটকে’ছে পুলিশ। আর বন্ধের বিরোধিতায় তৃণমূলের মিছিল ‘বাধাহীন’ পথে এগিয়েছে। কিছু মহলের দাবি, নাগরিক সমাজের আন্দোলন নকল করার সাধ্য গেরুয়া বাহিনীর নেই। আবার একাধিক মহলের মত, এই কর্মসূচিরও রাজনৈতিক গুরুত্ব খুবই। এতে নিশ্চিতভাবেই সুবিধা পাবে প্রধান বিরোধী দল। আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে শহর ছাপিয়ে গ্রামাঞ্চলেও আন্দোলন শুরু হওয়ায় চর্চা চলছে তৃণমূলের অন্দরে। তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক প্রদ্যোত ঘোষের কথায়, ‘‘যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, রাজনৈতিক চক্রান্তে না গিয়ে, সঠিক পথে দোষীদের ফাঁসির দাবি করুন। দোষীদের ফাঁসি তো আমরাও চাইছি।’’ তৃণমূলের অনুযোগ, আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদী আন্দোলনের অভিমুখ ঘোরানোর চেষ্টা করছে বিজেপি-সহ বিরোধীরা। জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক শুভজিৎ রায়ের পাল্টা দাবি, ‘‘আমরা তো মানুষের দাবিকে সামনে রেখেই প্রতিবাদ-আন্দোলন করছি।’’
একাধিক মহলের মতে, নাগরিকদের পথে নামাটা শাসকের জন্য দুশ্চিন্তার। ক’দিন আগে মেদিনীপুর গ্রামীণের নেপুরায় অরাজনৈতিক মিছিল হয়েছে ‘নেপুরা গ্রামবাসীবৃন্দে’র ডাকে। স্লোগান ছিল, ‘আমরা কারা? প্রতিবাদী’, ‘তোমরা কারা? প্রতিবাদী’, ‘এই মিছিলে হাঁটছে কারা? আছে যাঁদের শিরদাঁড়া’।
বুধবার বিজেপির ডাকা ১২ ঘণ্টার বন্ধ ঝাড়গ্রাম জেলায় কিছুটা প্রভাব পড়েছে। আমজনতার একাংশ জানাচ্ছেন, আর জি করের ঘটনায় সর্বসাধারণের মধ্যে এতটাই প্রভাব পড়েছে, যে অনেকেই বন্ধে সাড়া দিয়েছেন। বিক্ষিপ্ত রাজনৈতিক গোলমালও হয়েছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বন্ধ ভাঙতে পথে নেমে দোকানপাট খোলালেও ফের বিজেপির বাইক বাহিনী টহল দেওয়ায় দোকান-বাজার বন্ধ হয়েছে। জঙ্গলমহলের এই জেলার বিশিষ্টজনদের একাংশের আশঙ্কা, রাজনীতির আবর্তে ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলনের মূল সুরটি হারিয়ে যাবে না তো! ’’
ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা দহিজুড়ির একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা স্থিতা পাল বাগচী বলছেন, ‘‘দলতন্ত্রের মাঝে ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে যাচ্ছে। তবে নিরন্তর সম্মিলিত প্রতিবাদ চললে কিছু একটা হবে, আশা করা যায়।’’ বাচিকশিল্পী দেবরূপা রায় ভুইয়ের মতে, ‘‘যাঁরা রাজনীতি করছেন, তাঁদের ছোট না করেই বলছি, মানবিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ বাঁচুক।’’ মানবাধিকার কর্মী শ্রীমন্ত রাউতেরও মত, ‘‘নাগরিক প্রতিবাদ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলিকে বাদ দিয়ে। এতেই রাজনৈতিক দলগুলি এবং রাষ্ট্র শঙ্কিত হয়ে পড়ছে। তাই সামাজিক আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে এটিকে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা হচ্ছে।’’
তৃণমূল ও বিজেপি, দু'পক্ষ এ কথা মানতে নারাজ। ঝাড়গ্রাম জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি দেবাশিস কুণ্ডু বলছেন, ‘‘সমাজকে বাদ দিয়ে রাজনীতি হয় না। ফলে এমন আশঙ্কা অবান্তর।’’ তাঁর দাবি, ‘‘মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বন্ধে সাড়া দিয়েছেন।’’ ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মুর পাল্টা দাবি, ‘‘এ রাজ্যে বিজেপির সংগঠন নেই। হতাশা কাটাতে আর জি কর নিয়ে ওরা নোংরা রাজনীতি করতে চাইছে।’’