নিজের বাড়িতে দীপালি। —নিজস্ব চিত্র।
মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই বাবা মা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন। ফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষাটুকুও করতে রাজি ছিলেন না তাঁরা। গরিবের সংসারে তিন মেয়ে। বড়টিকে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘পার’ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ে নাছোড়। পুলিশকে ফোন করে বিয়ে বন্ধ করেছিল সে। এ পর্যন্ত যা যা ঘটনা তাতে নতুনত্ব বিশেষ কিছু নেই।
অনুপ্রেরণা তার পরের অংশ থেকে শুরু।
বিয়ে বন্ধ হওয়ার পর আত্মীয়, প্রতিবেশীদের কাছে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে নন্দকুমারের দীপালিকে। মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করার পরেও সে সব কটূক্তি বন্ধ হয়নি। তবে সাহায্য করেছিল থানা এবং বিডিও। পুলিশই ব্যবস্থা করেছিল একাদশে ভর্তি, বইপত্র এবং একটি সাইকেলের। ২০১৪ সালে সবুজসাথী প্রকল্পের সাইকেল মিলত না। পুলিশ-কাকুদের সাহায্যে নিয়ে পড়াশোনা করে দীপালি কর ২০১৬ উচ্চ মাধ্যমিকে ৭৮ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। এ বারও তাকে ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেই নন্দকুমার থানাই। বাড়ির কাছে নন্দকুমার কলেজেই ভর্তি করে দিয়েছেন ওসি অজয় মিশ্র। অজয়বাবু বলেন, ‘‘দীপালি খুবই মেধাবী। আমরা যতটা সম্ভব সাহায্য করছি। ওর সাফল্য অন্যদেরও উৎসাহিত করবে।’’
মাত্র দু’বছর আগেই পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম। মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হবে, সে দিন স্থির হয়ে গিয়েছিল। সোনার গয়না, বর-পণের টাকা জোগাড়, আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ— সবই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর পনেরোর দীপালি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত এক শুভানুধ্যায়ীর মাধ্যমে কোনও রকমে পুলিশকে ফোন করতে পেরেছিল। এরপর এগিয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় পুলিশ–প্রশাসনের আধিকারিকরাই। তাঁদের হস্তক্ষেপে বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এমনভাবে পরিবারের ‘নাম ডোবানো’র জন্য ক্রমাগত গঞ্জনা শুনতে হয়েছিল তাকে। সেই মেয়েটিই নিজের সাফল্য নিয়ে ভাবতে চায় না। আরও এগিয়ে যেতে চায়, লক্ষ্য শিক্ষিক হওয়া। ছোট দুই বোন রয়েছে। শেফালি দশম শ্রেণিতে পড়ে, আর সোনালি তৃতীয়। বোনেরাও পড়াশোনাটাই চালিয়ে যাক, চায় বড়দিদি।
দিঘা-কলকাতা সড়কের ধারে নন্দকুমার হাইরোড থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শীতলপুরের ছোট্ট বাড়িটাতে গিয়ে দেখা পাওয়া গেল বনমালী কর ও রীতা করের। বড় মেয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই বিনয়ের সুরে বনমালীবাবু বললেন, ‘‘আমি দিনমজুরি করি। পারিবারিক ৫ কাঠা জমি ছাড়া আর কোনও সম্বল নেই। তার উপর তিন মেয়ে। বড়মেয়ে মাধ্যমিক দেওয়ার পরই বিয়ে ঠিক করেছিলাম। ভেবেছিলাম এতেই মেয়ের ভাল হবে।’’ কিন্তু চোখ খুলে দিয়েছে বড় মেয়ে। কষ্ট করেও তাই এখন তিনি চান, ‘‘মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াক।’’
ছোটবেলা থেকেই দীপালি পড়ত স্থানীয় কল্যাণচক পঞ্চমী স্মৃতি কন্যা বিদ্যাপীঠে। ২০১৪ সালে সেখান থেকেই মাধ্যমিক দিয়েছিল। তারপর নন্দকুমার থানার পুলিশ ও তৎকালীন বিডিও-র সাহায্যেই কল্যাণচক গৌরমোহন ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হয় সে। স্কুলে যাওয়ার জন্য নন্দকুমার থানার পুলিশ একটি সাইকেলও কিনে দিয়েছিল, সঙ্গে প্রয়োজনীয় বইপত্রও। ‘‘না হলে হয়তো সত্যিই এত নম্বর পেতাম না’’, অকপটে জানায় দীপালি। এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে থেকে ৩৯১ নম্বর নিয়ে পাশ করেছে। বাংলায় ৭০, ইংরাজিতে ৭৪, শিক্ষাবিজ্ঞানে ৮১, ভূগোলে ৭১ ও দর্শনে ৯৫ পেয়েছে। কল্যাণচক গৌরমোহন ইন্সটিটিশনের সহকারী-প্রধান শিক্ষক দেবব্রত হোতা বলেন, ‘‘দীপালির এই সাফল্য দৃষ্টান্ত। ওর কথা বলে অন্য অভিভাবকদের বোঝাব।’’
এতদিনে মুখ বন্ধ করেছে প্রতিবেশীদেরও। ‘‘সে দিন যাঁরা বলেছিলেন, এ বার তুই কী করিস আমরা দেখব, দেখব তোকে কে দেখে— তাঁরাই এখন রাস্তায় জিজ্ঞেস করছেন পড়াশোনা কেমন চলছে’’, বলতে বলতে গলা কেঁপে যায় সদ্য সাবালিকা দীপালির।