মেদিনীপুর কালেক্টরেটে চলছে বৈঠক। শনিবার। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
প্রকল্প রয়েছে। অর্থও বরাদ্দ হয়। তবে সময়ে অর্থ খরচ হওয়া নিয়েই প্রশ্ন উঠল জেলা ভিজিল্যান্স ও মনিটরিং কমিটির বৈঠকে। শনিবার বৈঠকে পেশ করা রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থের একাংশ পড়ে থাকছে। সময়ের মধ্যে সব কাজও এগোচ্ছে না। বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে গড়িমসি নিয়ে শাসক দলকে বিঁধতে ছাড়ছে না বিরোধীরা। সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কটাক্ষ, “এখানে তেমন বিরোধিতা নেই। ২৯টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ২৮টিই তৃণমূলের। ১টি মাত্র কংগ্রেসের। তাও মানুষ কাঁদবে কেন? মুখ্যমন্ত্রী ২৬- ২৭ বার জেলায় এসেছেন। কিন্তু, কাজ কি সেই গতিতে এগোচ্ছে?”
মানসবাবুর মন্তব্য, “কাজের পর্যালোচনা হওয়া দরকার। মুখ্যমন্ত্রী জেলায় এসে বৈঠক করলে সেখানে বিরোধী দলের বিধায়কদের ডাকা হয় না। শাসক দলের বিধায়করা ভয়ে কিছু বলতে পারেন না! মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, চার বছর হয়ে গেল। এ বার জেলায় এসে বৈঠক করলে বিরোধী বিধায়কদের ডাকুন। সরকারি কাজের সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়!” কেন সময়ের মধ্যে সব কাজ এগোয়নি? বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দের একাংশ পড়েই থাকছে? কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই সব প্রশ্নের সদুত্তর এড়িয়ে গিয়েছে। বৈঠক শেষে জেলা ভিজিল্যান্স ও মনিটরিং কমিটির চেয়ারপার্সন তথা ঝাড়গ্রামের সাংসদ উমা সরেন শুধু বলেন, “বৈঠকে কাজের পর্যালোচনাই করা হয়েছে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরে এই কমিটি গঠন হয় গত বছরের ১৭ জুন। প্রকল্পগুলোর সঠিক রূপায়ণ হচ্ছে কি না, কোথাও কোনও সমস্যা দেখা দিচ্ছে কি না, সমস্যা দেখা দিলে সেগুলো কী কী, কী ভাবেই বা তার সমাধান হতে পারে, ভিজিল্যান্স ও মনিটরিং কমিটির এটাই দেখার কথা। কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ওই বছরের ২১ নভেম্বর। শনিবার ছিল কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক। অবশ্য, দ্বিতীয় বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের ৬ মার্চ। তা হয়নি। ৬ মার্চের বৈঠক বাতিল করে সদস্যদের জানানো হয়, বৈঠক হবে ২৩ মার্চ। তাও হয়নি। পরে সদস্যদের ফের জানানো হয়, পরবর্তী বৈঠক হবে ২৭ মার্চ। অবশ্য ২৭ মার্চের বৈঠকও হয়নি।
বার বার বৈঠক পিছনোয় সমালোচনার ঝড় ওঠে। সরব হন বিরোধী বিধায়করা। সমালোচনার মুখে পড়েই তড়িঘড়ি ফের কমিটির বৈঠক ডাকেন কর্তৃপক্ষ। এ দিন বৈঠকে অবশ্য বিরোধী বিধায়করা উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠক শুরু হয় সকাল দশটা নাগাদ। সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানসবাবু যখন কালেক্টরেটে পৌঁছন, তখন বৈঠক শেষ হয়ে গিয়েছে। পরে তিনি দেখা করেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) আর অজুর্নের সঙ্গে। মানসবাবু বলেন, “হাওড়ায় প্রচুর বৃষ্টির জন্য কলকাতা থেকে দিনীপুরে আসতে একটু দেরি হয়েছে।”
এ দিন বৈঠকে বিভিন্ন প্রকল্পের ২০১৪- ’১৫ অর্থবর্ষের কাজের অগ্রগতির হিসেব পেশ করা হয়। দেখা যায়, স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে জেলায় ৪৭,২৪২টি শৌচালয় তৈরি হওয়ার কথা ছিল। হয়েছে ২৭,৬৪২টি। বরাদ্দ ৩৩ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। বিআরজিএফ (অনুন্নত এলাকা উন্নয়ন) প্রকল্পে বরাদ্দ ১৪৫ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ১৩১ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা। ‘থার্ড স্টেট ফিনান্স’-এর বরাদ্দ ১৮৬ কোটি ৬২ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ১২৪ কোটি ৯৬ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা।
অন্য দিকে, ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের বরাদ্দ ২২৭ কোটি ৬০ লক্ষ ২ হাজার টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ১৮৬ কোটি ৬৩ লক্ষ ২১ হাজার টাকা। ইন্দিরা আবাস যোজনায় জেলায় ৩৬,৯৮৯টি বাড়ি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। হয়েছে ২৫,৫৭৬টি। জেলায় একশো দিনের প্রকল্পে কাজ হয়েছে ৪৬০ কোটি ২৯ লক্ষ টাকার। অথচ, মজুরি বকেয়া রয়েছে ২৩৫ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। মানসবাবুর কথায়, “কেন্দ্র ধীরে ধীরে একশো দিনের কাজ সঙ্কুচিত করছে। গ্রামাঞ্চলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আমি বিধানসভায় বলেছি, এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ হওয়ার দরকার। একটা টিম দিল্লি চলুক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নেতৃত্ব দিন। আমাদের আপত্তি নেই। অবশ্য, সর্বদলীয় টিম নিয়ে গিয়ে দিল্লিতে দরবার করা হবে, এই সিদ্ধান্ত হয়নি।”
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেলাশাসক তথা কমিটির সচিব জগদীশপ্রসাদ মিনা-সহ বিভিন্ন দফতরের পদস্থ আধিকারিকেরা। ছিলেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ, কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ, শৈবাল গিরি, অমূল্য মাইতি প্রমুখ। ছিলেন মৃগেন মাইতি, দুলাল মুর্মু প্রমুখ তৃণমূল বিধায়কও। মানসবাবু বলেন, “১১ হাজার বাড়ি কেন সময় মতো গরিব মানুষ পেলেন না, এর জবাব কে দেবে? সবং পঞ্চায়েত সমিতির সঙ্গে সবক্ষেত্রে অসহযোগিতা করা হচ্ছে।”
যদিও মানসবাবুর দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন মেদিনীপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা এমকেডিএ- র চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতি। তাঁর কথায়, “কেউ যদি বিরোধীতা করার জন্যই বিরোধীতা করেন, করতে পারেন! কিছু বলার নেই। জেলায় গত চার বছরে প্রচুর কাজ হয়েছে।” মৃগেনবাবু বলেন, “আমি নিজে পিএইচই- র ডিএলসি- র চেয়ারম্যান। জানি পানীয় জল প্রকল্পের কত কাজ হয়েছে। নলবাহিত জলপ্রকল্পে কত কত মানুষ উপকৃত হয়েছেন। জেলায় বিভিন্ন কমিটি রয়েছে। সেখানে নিয়মিতই কাজের পর্যালোচনা করা হয়।” তাঁর কথায়, “একশো দিনের প্রকল্পের টাকা কেন্দ্র দেয়। কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলেই মজুরি পেতে সমস্যা হচ্ছে। এটা তো কারও অজানা থাকার কথা নয়!” মৃগেনবাবুর দাবি, “বৈঠকে সরকারি প্রকল্পগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তেমন কোনও সমস্যা সামনে আসেনি।”
কেন এলেন না বৈঠকে? কেশপুরের সিপিএম বিধায়ক রামেশ্বর দোলুই বলেন, “এ দিন অন্য কর্মসূচি ছিল। তাই বৈঠকে যেতে পারিনি। এ ভাবে কি বৈঠক হয়? বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট আমাদের কাছে আগে পাঠানো উচিত। রিপোর্ট দেখেই তো বুঝব কোন কাজ কতটা এগিয়েছে। কোথাও সমস্যা দেখলে তাই তো বলব। শুধু বৈঠকের দিন বলে দিলেই হল! এই বৈঠক আগেই হওয়া উচিত ছিল। পরপর তিনবার বৈঠক ডেকেও তা বাতিল করা হয়।”