পুলিশের গার্ড রেল দিয়ে ঘেরা সেই রাস্তা। নিজস্ব চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লালবাতি লাগানো গাড়ি ব্যবহার করেন না। তাঁকে বারবার এ-ও বলতে শোনা যায়, সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয় এমন কিছু তিনি করেন না। অথচ শহর মেদিনীপুরের একটি রাস্তা রাতের বেলায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে ‘নো-এন্ট্রি’ জ়োন হয়ে যায়। সাইকেল, বাইক, গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হয় না। এমনকি পথচারীদেরও সেখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেওয়া হয় না।
বার্জটাউনের অদূরে ওই রাস্তা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলির মধ্যে এটি একটি। আশেপাশে রয়েছে জেলা পুলিশের কার্যালয়, জেলা পুলিশ সুপারের আবাসন, পূর্ত দফতরের একাধিক কার্যালয়, একাধিক পূর্ত আধিকারিকের আবাসন। একাধিক সরকারি-বেসরকারি অফিস, ঘরবাড়িও। স্থানীয় সূত্রে খবর, রাত হলেই রাস্তার দু’দিকে গার্ডরেল দিয়ে ব্যারিকেড করা হয়, ‘নো-এন্ট্রি’ জ়োনের মতোই। দু’দিকেই থাকে কড়া পুলিশি প্রহরা। কেউ হেঁটেও যাতে এই রাস্তায় ওই সময়ে যাতে যেতে না পারেন, সতর্ক নজর রাখেন পুলিশকর্মীরা। রোজই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। শনিবার রাতে যেমন এই রাস্তা ধরে লোকনাথপল্লির দিকে যেতে চেয়েছিলেন সুজিতকুমার শীট। পারেননি। ব্যারিকেডে তাঁকে আটকে পড়তে হয়। ক্ষুব্ধ সুজিত বলছিলেন, ‘‘অনেক দিন ধরেই বন্ধ থাকছে এটি। প্রতিদিন রাতের এই সময়ে। হয় বাসস্ট্যান্ডের সামনে হয়ে ঘুরে যেতে হয়। নয়তো সিপাইবাজার হয়ে ঘুরে যেতে হয় আমাদের।’’
নাইট কার্ফু নেই। করোনার বিধিনিষেধ নেই। তবু কেন বন্ধ রাস্তা?
কর্তব্যরত একাধিক পুলিশকর্মী জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মতো তাঁরা এখানে ডিউটি করেন। তাঁদের কথায়, ‘‘আমাদেরকে এখানে ডিউটিতে পাঠিয়েছে, আমরা ডিউটি করি।’’ তবে তাঁরা মেনেছেন, রাত সাড়ে ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এই রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ হয়। এক পুলিশকর্মী শুনিয়েছেন, ‘‘আমরা থাকি। ভ্যানপার্টিও (পুলিশের মোবাইল ভ্যান) থাকে।’’ জেলা পুিলশ সুপার দীনেশ কুমারকে রবিবার কয়েকবার ফোন করা হয়। ফোন রিং হয়ে গিয়েছে। তিনি ধরেননি। জেলা পুলিশ সূত্র মনে করাচ্ছে, প্রয়োজনে রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
বিরোধীরা অবশ্য পুলিশকে বিঁধছে। বিঁধছে শাসক দলকেও। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘‘শাসক দলের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই সব হচ্ছে।’’ এরপরই তাঁর খোঁচা, ‘‘কারও ঘুমের ব্যাঘাতের জন্য এ ভাবে ব্যারিকেড করে রাস্তা ঘিরে দেওয়া হচ্ছে, না কোনও অনৈতিক কাজ চলে ওখানে, সেই জন্য ওই সময়ে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে, তার জন্য এমনটা করা হচ্ছে, এটা আমি পার্টি অফিসে থেকে বলতে পারব না। খুঁজে বের করার দায়িত্ব সাংবাদিকদের।’’ বিজেপির জেলা সহ- সভাপতি অরূপ দাসের দাবি, ‘‘পুলিশ আধিকারিকের নিরাপত্তার জন্য একটা রাস্তা দিনের পর দিন ঘিরে রাখা হচ্ছে। শুধুমাত্র পুলিশ আধিকারিকের জীবনের মূল্য রয়েছে? মেদিনীপুর শহরে রাতে মানুষ সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কখনও চুরি হচ্ছে, কখনও ছিনতাই হচ্ছে, কখনও ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে। বাইক ছিনতাই তো লেগেই রয়েছে। মেয়েদের ইভটিজিংয়ের সামনে পড়তে হচ্ছে। এটা রাতের বেলায় হামেশাই ঘটছে।’’
মা-মাটি-মানুষের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। সেই পুলিশের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। অভিযোগ করছেন, পুলিশ মানুষের নিরাপত্তার চেয়ে নিজের নিরাপত্তার কথা বেশি ভাবছে। অরূপ বলেন, ‘‘আমি এও শুনলাম, মুখ্যমন্ত্রী যে দু’দিন ছিলেন মেদিনীপুরে, সেই দু’দিন না কি ওই এলাকার রাস্তাটা ঘেরা ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর চোখে পড়ে গেলে কাউকে ধমকাতে পারেন। সেই ভয় ছিল! শুনেছি, রাতে ওই রাস্তায় অ্যাম্বুল্যান্সও যেতে দেওয়া হয় না।’’
গত বছর অগস্টের ঘটনা। শুরুতে শহরতলি, পরে শহর। মিনিট কুড়ির ব্যবধানে রাতের মেদিনীপুরে পরপর দু’জায়গায় গুলি চলে। তোলা চেয়ে হুমকিও দেয় দুষ্কৃতী। স্থানীয়দের একাংশ মনে করাচ্ছেন, ঘটনাচক্রে ওই ঘটনার পরপরই তাঁরা রাতে এখানে এমন পুলিশি- ব্যারিকেড দেখছেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা বলেন, ‘‘ওই রাস্তায় রোজ এমন ব্যারিকেড থাকে বলে আমি জানতাম না! আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি পুলিশ দেখে। নিশ্চয়ই প্রয়োজনে পুলিশ এই পদক্ষেপ করেছে।’’ তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক আশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ওই রাস্তায় রাতে ব্যারিকেড থাকে বলে শুনেছি। সমস্যা হয়ে থাকলে বিষয়টি দলীয় নেতৃত্বের নজরে আনব। মানুষ সমস্যায় পড়তে পারেন- এমন কোনও কাজ আমাদের সরকার করে না।’’
বিরোধীদের কটাক্ষ, পুলিশ তো এখন ‘ভগবান’। তাই নিদ্রা যাওয়ার সময় কোনও গোলযোগ সহ্য করতে পারে না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।