দলবদল করা চার বিজেপি কাউন্সিলরের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্ব। রয়েছেন পুরপ্রধান পদের দাবিদার প্রদীপ সরকারও (হালকা বেগুনি পাঞ্জাবি)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
চার বিজেপি কাউন্সিলর দলে আসার পরে এই মুহূর্তে খড়্গপুরে বৃহত্তম দল তৃণমূল। ফলে, পুরপ্রধান পদের দাবিদারের নামও ঘোষণা করে দিলেন নেতৃত্ব। রেলশহরে তৃণমূলের যে দুই নেতার মধ্যে দীর্ঘ দিনের কোন্দল, সেই প্রাক্তন পুরপ্রধান জহরলাল পাল বা দলের শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরী কাউকেই অবশ্য এ বার পুরপ্রধান পদপ্রার্থী হিসেবে রাখছে না শাসক দল। পরিবর্তে খড়্গপুরে তৃণমূলের পুরপ্রধান পদের দাবিদার হলেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী প্রদীপ সরকার ওরফে খোকন। বৃহস্পতিবার খড়্গপুর শহরের খরিদায় দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে এমন কথাই জানিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
জহরবাবু এবং দেবাশিসের গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ দীর্ঘ দিনের। এমনকী এ বারও পুরভোটের আগে প্রার্থী বাছাই নিয়ে দুই গোষ্ঠীর বিরোধ চরমে পৌঁছেছিল। সেই বিরোধে রাশ টানতেই তৃতীয় কাউকে পুরপ্রধান করার কথা ভেবেছে দল। তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি দীনেন রায় এ দিন বলেন, “রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ মেনেই প্রদীপ সরকারকে পুরপ্রধান পদপ্রার্থী তথা দলনেতা করা হয়েছে। এর বাইরে কিছু বলতে পারব না।’’ আর তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি অজিত মাইতির বক্তব্য, “আমাদের জহরলাল পাল ও দেবাশিস চৌধুরী দু’জনেই চেয়েছেন নতুন মুখ কাজ করুক।’’
২০১০ সালের ভোটের পরে পুরপ্রধান হয়েছিলেন জহরলালবাবু। সে বার ভোটে হেরে যান দেবাশিস। তখন থেকেই পুরপ্রধানের পদ নিয়ে জহর-দেবাশিস গোষ্ঠী কোন্দলের সূত্রপাত। সেই সময় দেবাশিস যাঁকে পুরপ্রধান করতে চেয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা মানা হয়নি। ২০১৩ সালে অনাস্থা ভোটে হেরে তৃণমূলের ক্ষমতা হারানোর পিছনেও গোষ্ঠী কোন্দল রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। এ বছর পুর-নির্বাচনের আগে প্রার্থী বাছাই নিয়ে দুই গোষ্ঠীর বিবাদ চরমে ওঠে। শেষমেশ জেলা নেতৃত্বকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এ বার অবশ্য জহর-দেবাশিস দু’জনেই জিতেছেন। ফলে, পুরপ্রধানের দাবিদার ছিলেন দু’জনেই। কিন্তু এ দিন সে সব দূরে সরিয়ে একেবারে নতুন মুখ প্রদীপের নাম পুরপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এ ব্যাপারে জহরবাবুর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে তিনি ছিলেন না। মোবাইলেও পাওয়া যায়নি তাঁকে। তবে দেবাশিস বলেন, ‘‘দলে আমাদের মতবিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু কখনও তা প্রকাশ্যে আসেনি। এ ক্ষেত্রেও শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়েছি।’’
গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ঠেকাতে প্রদীপকেই বাছা হল কেন?
তৃণমূল সূত্রে খবর, এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার নিরিখে তৈমুর আলি খান ও প্রদীপ সরকারের নাম উঠে এসেছিল। কিন্তু প্রদীপ স্নাতক, জনসংযোগেও দক্ষ। তাই সব দিক বিচার করে তাঁর নামই পুরপ্রধান পদপ্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেন রাজ্য নেতৃত্ব। তৃণমূলের দলীয় সূত্রে খবর, জেলা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিকও প্রদীপের নামই প্রস্তাব করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না বিরোধীরাও। সিপিআইয়ের জেলা সহ-সম্পাদক বিপ্লব ভট্ট বলেন, “তৃণমূলের এখন সবাই নেতা। তাই দলের নেতারা ঠিক করে দিতে পারেন না কে পুরপ্রধান হবেন। সেখানে সরকারি আধিকারিকেরা ঠিক করে দিচ্ছেন পুরপ্রধান কে হবেন।’’ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য মনোজ ধরেরও বক্তব্য, “শুনেছি জেলার পুলিশের এক কর্তা খোকন সরকারের নাম ঠিক করে দিয়েছেন। এটা তৃণমূলের মতো অগণতান্ত্রিক দলেই সম্ভব।’’
তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি অজিতবাবুর অবশ্য যুক্তি, “খড়্গপুর মানেই রেল। তাই রেল এলাকাকে গুরুত্ব দিতে খোকনের মতো দক্ষ ও সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যুক্ত একটি জনপ্রিয় মুখ দলনেতা হিসেবে প্রয়োজন ছিল। উচ্চ নেতৃত্বই সব ঠিক করেছেন।’’ নতুন দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিচ্ছেন প্রদীপ। তাঁর বক্তব্য, “দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বেছেছেন। কারণ, আমি অরাজনৈতিক ভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। ভবিষ্যতেও রাখব।’’
৩৫ আসনের খড়্গপুর পুরসভার ফল হয়েছিল ত্রিশঙ্কু। কংগ্রেস ও তৃণমূল ১১টি করে আসন পেয়েছিল। বামেরা জেতে ৬টিতে আর বিজেপি পায় ৭টি আসন। এ দিন বিজেপির চার জন আসায় তৃণমূলের আসন বেড়ে দাঁড়াল ১৫। ফলে, বৃহত্তম দল হিসেবে বোর্ড গঠনে অগ্রাধিকার পাবে তৃণমূল। কিন্তু তাতে বোর্ড গঠন নিশ্চিত হচ্ছে না। কারণ, মামলায় নাম জড়ানোয় জহরলাল ভোটাভুটিতে যোগ দিতে পারবেন না। ফলে, তৃণমূলের সংখ্যা কমে দাঁড়াল ১৪। অন্য দিকে, বামেদের সমর্থন চেয়েছে কংগ্রেস। সে ক্ষেত্রে জোটের আসন হবে ১৭। তিন বিজেপি কাউন্সিলর ভোটাভুটিতে কোন দিকে যান, সেটাও দেখার। এই সব অঙ্কের প্রেক্ষিতেই শহর কংগ্রেস সভাপতি অমল দাস বলেন, “বোর্ড গঠনের ব্যাপারে আমরা এখনও আশাবাদী।”