ভাদুতলা চোখে পড়ল না বাহিনীর টহল। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
ছক কষা হয়ে গিয়েছে। এ বার শুধু কাজটা করার অপেক্ষা।
ভোটের আগের দিনই প্রায় তৈরি শাসক শিবির। ঠিক কী ভাবে এগোচ্ছে কাজ? জানা গেল, কট্টর বিরোধী ভোটারদের শাসানি দিয়ে বলা হচ্ছে, “ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই। ভালই তো আছ।” আবার তৃণমূল সমর্থক মহিলা ভোটারকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, “বৌদি সকালে উঠেই আগে ভোটটা দেবেন। তারপর যেখানে খুশি যাবেন। আগের বারের মতো বাপের বাড়ি চলে যাবেন না।’’ মেদিনীপুরের এক তৃণমূল কর্মীর কথায়, ‘‘এতেই কাজ হয়ে যায়। গ্রামীণ এলাকায় আমাদের লক্ষ্য বুথ পিছু গড়ে ১৫০টি ভোটের লিড। পুরসভা আমাদেরই। ওখানে একটু বেশি লিড হবে। তাহলেই ৫০ হাজার ভোটে জিতে যাবেন আমাদের প্রার্থী।’’
এই হিসেব সব জায়গায় মিলবে?
গোদাপিয়াশালে গিয়ে শোনা গেল অন্য কথা। স্থানীয় এক বাসিন্দা চুপি চুপি বলে গেলেন, “এখন সবাই শাসক দলের লোক সেজে রয়েছে। ভোট গণনার পর দেখবেন সত্যি অবস্থাটা কী?” তলায় তলায় তাই চাপা উত্তেজনা রয়েছে তৃণমূল শিবিরেও। তাই অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবগুলির সদস্যদের সরাসরি ফোন করছেন তৃণমূল প্রার্থী মৃগেন্দ্রনাথ মাইতি। এক ক্লাব সদস্যের কথায়, “হঠাৎ অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। ফোন ধরতেই শুনি বলছেন, ‘ভাইপো। এবার ভোটটা কিন্তু উতরে দিতে হবে।’’ মৃগেনবাবু নিজে যদিও এ সব মানছেন না। শুধু বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে যা উন্নয়ন হয়েছে, তাতে মানুষ আমাদের সঙ্গেই থাকবে।’’
চুপিসাড়ে নানা পরিকল্পনা তৈরি ছাড়া বিধানসভা ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে অনেকটাই নিরুত্তাপ ঠেকল মেদিনীপুরকে। তৃণমূলের সুর আত্মবিশ্বাসী। কর্ণগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল অঞ্চল সভাপতি কাঞ্চন চক্রবর্তী তো বলেই ফেললেন, ‘‘বিরোধীরা কোথায়? জোট-ঘোঁট এত কিছু করেও তো হাতে গোনা দু’-চারটি মিছিল করেছে। তাও গোটা তিরিশেক লোক। বেশিরভাগই বাইরের।’’ গত লোকসভা নির্বাচনে কোন বুথে ৯২, কোন বুথে ১৩০ ভোটে তৃণমূল এগিয়ে ছিল তারও হিসেব দিয়ে দিলেন কাঞ্চনবাবু। তারপর বললেন, “এ বার লিড আরও বাড়বে। ছেলেমেয়েদের সাইকেল দেওয়া, কন্যাশ্রী, ক্লাবে ক্লাবে অনুদান— এত উন্নয়ন কি
বিফলে যাবে!’’
এই নিস্তরঙ্গ পরিস্থিতিই ভরসা জোগাচ্ছে বিরোধীদের। মেদিনীপুর বিধানসভার বিজেপি প্রার্থী তুষার মুখোপাধ্যায় যেমন বললেন, “নিবার্চনের আগের দিন পর্যন্ত তেমন অঘটন ঘটেনি। তবে নির্বাচনের দিন কী হবে বলা কঠিন। সাধারণ মানুষও ভীষণ চুপচাপ। তাই আমরা আশাবাদী।’’ তাই বলে দু’-একটি জায়গায় হুমকির সুর শোনা যাচ্ছে না, এমন নয়। সিপিআইয়ের অভিযোগ, শালবনি এলাকায় থাকা কর্ণগড়, গড়মাল-সহ কিছু এলাকায় বিরোধীদের হুমকি দিচ্ছে শাসক দল। তবে আশ্বাসের কথা হল, প্রতিরোধও তৈরি হচ্ছে। সিপিআই প্রার্থী সন্তোষ রাণার কথায়, “এটা ঠিক যে, এখনও বড় ঘটনা ঘটেনি। ছোটখাটো যে সব হুমকি চলছে, তার প্রতিরোধও করছে গ্রামের মানুষ। তবে ভোটের দিনে বুথের পাশাপাশি বুথের বাইরে, রাস্তাতে পুলিশি টহল না থাকলে সমস্যা হবে।”
বুথের বাইরে ভোটারদের আটকে দেওয়া, বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ভোটের রেওয়াজ সেই বাম আমল থেকে রয়েছে। সে সবের আশঙ্কা এ বারও রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, আগে থেকেই ভোটারদের বুথমুখো হওয়া ঠেকাতে নেমেছে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকরা। টাকা লেনদেনের অভিযোগও উঠছে। শনিবারই মেদিনীপুর শহরে মোটরবাইকের ডিকিতে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ঢুকছিলেন একজন। অন্যজনের কাছে ছিল ২ লক্ষ টাকা। কেরানিতলাতে পুলিশের তল্লাশি চলাকালীন ধরা পড়ে। ২ লক্ষ টাকা শ্রমিকদের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন প্রমাণ দেওয়ার পর দ্বিতীয় জন ছাড়া পান। কিন্তু পাঁচখুরির লোকটি ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে কেন শহরে ঢুকছিলেন, তার নথি দেখাতে পারেননি। পুলিশ টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে।
কমিশন অবশ্য আঁটোসাঁটো নিরাপত্তার কথাই শোনাচ্ছে। জানাচ্ছে, এ বার প্রতিটি বুথে থাকছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সেই সঙ্গে কিছু বুথে মাইক্রো অবজারভার, সিসিটিভি, ভিডিও ক্যামেরার বন্দোবস্ত।
কিন্তু তাতেও স্বস্তি নেই। নিজের ভোটটা দেওয়া যাবে তো— আশঙ্কা বিঁধছে ২৪ ঘণ্টা আগে থেকেই।