আবাস যোজনার সমীক্ষায় জেলাশাসক। — ফাইল চিত্র।
উন্নয়ন আর বিতর্ক যেন আলো আর ছায়া। উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়ালেও সমস্যা। দুয়ারে পৌঁছলেও। এ ক্ষেত্রে বোধহয় সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়তে হয় উন্নয়ন বাহকদেরই। বাম আমল হোক বা তৃণমূলের সময়কাল, ওঁদের (যাঁরা উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেন তৃণমূল স্তরে) নিরাপত্তাহীনতার ছবিটা পরিবর্তন হয় না এতটুকু।
সময়টা নব্বইয়ের দশক। সিপিএমের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর তখন উত্তুঙ্গ আন্দোলন চলছে জঙ্গলমহলে। জামবনি, বিনপুরে খুন-পাল্টা খুনের ঘটনায় রক্তাক্ত রাজনীতির আঙিনা। সিপিএমের এক প্রাথমিক শিক্ষক নেতা তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুরের দলীয় কার্যালয়ে হাজির হয়ে জানিয়েছিলেন, এলাকায় কাজ করতে গিয়ে ‘টার্গেট’ হয়ে যাচ্ছেন তিনি।
প্রায় দেড় দশক পর জঙ্গলমহল তখন মাওবাদী সন্ত্রাসে অশান্ত। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে লালগড়ের বেলাটিকরি অঞ্চলের জামদা প্রাথমিক স্কুলে হানা দেয় মাওবাদীরা। শিশু পড়ুয়াদের সামনে মাওবাদীরা পার্শ্বশিক্ষক কার্তিক মাহাতোকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। সিপিএমের দলীয় সদস্য কার্তিকের অপরাধ ছিল, তিনি এলাকার খবরাখবর দলের কাছে পৌঁছে দিতেন। তাই তাঁকে খুনের পর পোস্টারে ‘পুলিশের চর’, ‘সিপিএমের চর’ তকমা দেওয়া হয়েছিল।
এখন আবাস যোজনার তালিকা (প্রশাসনিক স্তরে তা আবাস প্লাস হিসেবে পরিচিত) যাচাইয়ে গিয়ে আশা, অঙ্গনওয়াডি কর্মীদের যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নব্বইয়ের দশক বা মাওবাদী সন্ত্রাস পর্বে ঠিক তেমনি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল শিক্ষকদের। অর্থাৎ উন্নয়ন বাহকদের ভরকেন্দ্র বদলেছে। একই রয়েছে তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা। এসইউসি প্রভাবিত আশা কর্মী সংগঠনের জেলা নেত্রী জ্যোৎস্না মাইতি বলছেন, ‘‘ইউনিফর্ম পরে আশাকর্মীরা সমীক্ষা করে এসেছেন। ফলে সব আশাকর্মীই এখন টার্গেট হয়ে যাচ্ছেন। তালিকা তো আমরা করিনি। প্রকৃত প্রাপকদের নাম তালিকায় রয়েছে কি-না এটা খতিয়ে দেখতে গিয়ে আমরা ভীষণরকম চাপে রয়েছি।’’ বস্তুতপক্ষে একাংশ আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বলছেন, ‘‘প্রশাসনিক সভায় লোক ভরানোর জন্য আমাদের ডাকা হয়। শাসকদলের সভাতেও যেতে হয়। ফলে এলাকার লোকজন ধরেই নেন, নিচুতলায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রাণিসম্পদ পরিষেবার কাজে যুক্তরা শাসকদলেরই মুখ।’’
শাসকদলের মুখ হলেই যে সংঙ্কট কাটবে এমন নিশ্চয়তা নেই। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উল্টোটাই হচ্ছে। ঝাড়গ্রামের এক আশাকর্মী বলছেন, ‘‘তালিকা নিয়ে গ্রামে গিয়ে দেখেছি, বর্তমান শাসকদলের কর্মীর নামে বাড়ি বরাদ্দ হয়েছে, যাঁর পাকা দোতলা বাড়ি রয়েছে। আবার শাসকদলেরই কর্মী যাঁর ঝুপড়ি ঘর তাঁর নাম প্রাপক তালিকায় নেই। কিন্তু এই কাজ করে আসার পর এখন তো আতঙ্কে রয়েছি। যাঁর বাড়ি আছে, তাঁর নাম বাদ গেলে আমার উপর চাপ আসবে। আবার যিনি বাড়ি পাননি তিনিও দলবল নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির হয়ে শাসিয়ে যাচ্ছেন। করবটা কী!’’ এসইউসি প্রভাবিত ‘স্কিম ওয়ার্কার্স ফোডারেশন অফ ইন্ডিয়া’র ঝাড়গ্রাম জেলার নেত্রী অর্চনা বেরা বলছেন, ‘‘আশাকর্মীরা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলের রোষের মুখেও পড়ছেন।’’
বাম আমলে জেলা ছিল বড়। প্রশাসন তৃণমূল স্তরে পৌঁছত না। জনগণ, প্রশাসন ও শাসকদলের মাঝে থাকতেন শিক্ষকেরা। তৃণমূলের আমলে প্রশাসন পৌঁছচ্ছে দুয়ারে। এখন জনগণের অভাব, অভিযোগ প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। তাঁরাই আবার প্রশাসন পরিকল্পিত প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা নিয়ে হাজির হচ্ছেন মানুষের দুয়ারে। রাজ্যে পালাবদলের পর থেকে অন্য সংগঠনের মতো বামেদের শিক্ষক সংগঠনেও নেমেছিল ধস। আবার এখন আশাকর্মীদের যে বাম রাজনৈতিক দল সংগঠিত করছে সেই এসইউসি একসময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেছিল।
সময়ের জোয়ার ভাটায় বদলে যায় সমীকরণ। চলতে থাকে ভাঙাগড়ার খেলা। পরিবর্তনের ঝোড়ো হাওয়ায় অন্য সংগঠনের মতো বামেদের শিক্ষক সংগঠনও হয়েছিল কঙ্কালসার। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলায় সিপিএম প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ-এর সদস্য সংখ্যা গত বছরের তুলনায় সামান্য বেড়েছে। তবে সিপিএমেরই (প্রভাবিত) প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠন এবিপিটিএ সংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই। গত বছর যা ছিল ৫৮৬ জন, এ বছর ডিসেম্বরে এখনও পর্যন্ত সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৭৩ জন।
শিক্ষক থেকে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী—মাঝেমধ্যে উন্নয়ন রেয়াত করে না তার বাহকদেরও! (শেষ)