দিন গিয়েছে, সিপিয়া-স্মৃতিতে বাঁচে স্টুডিওপাড়া

এনলার্জার-প্রিন্টিং ফ্রেম-ফরসেপ-গ্লেজিং মেশিন-ডার্ক রুম— সব যেন পুরনো ছবির মতো ‘সিপিয়া এফেক্ট’-এ চলে গিয়েছে। এখন হাতে হাতে মোবাইল। সে যন্ত্রে দিব্যি এঁটেছে অটোস্টিচ-স্লো শাটার ক্যাম-অ্যাভিয়ারি-স্ন্যাপসিড।

Advertisement

বরুণ দে

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৫ ০১:০২
Share:

প্রয়াত আলোকচিত্রী কনক দত্তর লেন্সে বন্দি বিশিষ্টরা। (ডান দিকে) তাঁর স্বপ্নের ‘স্টুডিও স্টাইল’ এখন বন্ধ। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

এনলার্জার-প্রিন্টিং ফ্রেম-ফরসেপ-গ্লেজিং মেশিন-ডার্ক রুম— সব যেন পুরনো ছবির মতো ‘সিপিয়া এফেক্ট’-এ চলে গিয়েছে। এখন হাতে হাতে মোবাইল। সে যন্ত্রে দিব্যি এঁটেছে অটোস্টিচ-স্লো শাটার ক্যাম-অ্যাভিয়ারি-স্ন্যাপসিড।

Advertisement

সেকালের স্টুডিওপাড়া আজ ধুঁকছে। হবে না-ই বা কেন? স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলেন ক’জন? এমনকী পাসপোর্ট ছবি তোলার সময়ও মানুষ মোবাইল থেকে খুলে বাড়িয়ে দিচ্ছেন ‘মেমোরি চিপ’। শুধু একখানা প্রিন্ট দিলেই হল। তাতে খরচও বেশ কম। আর সাধের ছবি? সরস্বতী পুজোয় মেয়ের প্রথম শাড়ি পড়া বা প্রথম প্রেমিকের সঙ্গে তুলে রাখা গোপন ছবিখানার জন্য এখন তো আর ‘ক্যামেরা কাকু’র দরকার হয় না। মামিমা কি ও পাড়ার পিসি সম্বন্ধ করার জন্যও ছবি চেয়ে পাঠান না। ঘটক তো কবেই বিদায় নিয়েছেন। এখন শুধু ‘আপলোড’ করলেই কাজ চলে যায়।

আর শুধু কি মোবাইল, হাত হাতে ঘুরছে দামী ক্যামেরা— সবাই ‘আলোকচিত্রী’। পেশাদার আলোকচিত্রী অরূপলাল পাত্রের কথায় সেই আক্ষেপই ঝরে পড়ে, “এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল-ডিজিট্যাল। শুনেছি, বছর ৪০ আগে ভোর সাড়ে চারটেয় স্টুডিও খোলা হত বন্ধ হত প্রায় রাত বারোটায়। ৩০-৩৫ জন কর্মচারী ছিলেন। রাতদিন এক করে কাজ চলত।” অরূপবাবু এখন শহরের ‘মডার্ন স্টুডিও’ চালান।

Advertisement

শুধু এই ‘মডার্ন স্টুডিও’ই নয়, এক সময় শহর মেদিনীপুরে রমরমিয়ে চলত ‘স্টুডিও স্টাইল’, ‘ফটো সার্ভিস’, ‘উর্জ্জনা স্টুডিও’ প্রভৃতি। এখন কোনওটা বন্ধ, কোনওটা ধুঁকছে। প্রয়াত আলোকচিত্রী কনক দত্তর স্টুডিও ছিল ‘স্টুডিও স্টাইল’। শহরের বড়বাজারের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে স্টুডিও চলত। দলবেঁধে ছবি তোলার জন্য স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও আসত।

কনকবাবুর স্ত্রী অনিমা দত্তের কথায়, “সেকালের সঙ্গে ফারাক। তখন দোলের সময় পাড়ার ছেলেরা দলবেঁধে আসত। এক-একজন এক-এক রঙে সাজত। পুজো দেখতে বেরিয়েও অনেকে ছবি তুলতে আসত। বিয়ের পরে নতুন বর-বউ ছবি তুলতে আসত। এক-একটা পরিবারের সকলে এসে গ্রুপ ফটো তুলত। এখন স্টুডিওতে এসে ছবি তোলার সেই উত্‌সাহটাই আর নেই।” ‘স্টুডিও স্টাইল’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেদিনের কথা ভাবলে এখনও টুকরো টুকরো কত কথা মনে পড়ে অনিমাদেবীর।

স্কুলবাজারের ‘ফটো সার্ভিস’ নিমাইচন্দ্র কুণ্ডুর স্টুডিও বলেই পরিচিত ছিল। নিমাইবাবু প্রয়াত হয়েছেন। এখন স্টুডিওটি চালান তাঁর ছেলে স্বরূপ কুণ্ডু। স্বরূপও বলছেন, “এখন আর স্টুডিও তেমন চলে না। আগে উত্‌সব-অনুষ্ঠানে স্টুডিওতে এসে ছবি তোলার চল ছিল। বিয়ের দেখাশোনার সময়ও ছেলেমেয়েরা স্টুডিওতে এসে ছবি তুলত। এখন এ সব প্রায় বন্ধ। এখন অনেকেই মোবাইলে ছবি তুলে চিপ নিয়ে আসেন। স্টুডিওতে এসে বলেন শুধু প্রিন্ট কপি বের করে দিতে।’’

ছবি তোলার ইতিহাস ১৭৬ বছরের পুরনো। এক সময় ফিল্ম-ক্যামেরার রমরমা ছিল। এখন তাও সংগ্রহশালায় চলে গিয়েছে। আলোকচিত্রের প্রথম উদ্ভবের সময় থেকেই তার প্রধান দায় ছিল বাস্তবকে স্বাভাবিকতায় রূপবদ্ধ করা। আলোকচিত্র যখন ছিল না তখন সেই কাজটি করতে হত চিত্রকলাকে। কিন্তু বাস্তবের অন্তরাল থেকে সত্য উন্মোচন করাটা অবশ্য যে কোনও শিল্পেরই আসল লক্ষ্য। তাই অভিজ্ঞতা সে পথেই নিয়ে চলল আলোকচিত্রকেও।

অরূপবাবুরা বলছেন, “যে কোনও ছবির সার্থক রূপদানে মূল কথা হচ্ছে ল্যাবরেটরি। তখন ডার্করুম ছিল। ফটোগ্রাফি বিষয়ে প্রকৃত শিক্ষার কাজ শুরু হয় সেখানেই।’’ ক্যামেরায় ছবি তোলার পর শুরু হয় ফটোগ্রাফ তৈরির কাজ, এই ডার্করুমেই। আগে ছবি তৈরি হত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরে—ডেভেলপিং, প্রিন্টিং এবং এনলার্জিং।

তাই ছবি তোলার সঙ্গে ডার্ক রুমে ছবি তৈরি— দু’টোই শিখতে হত আলোকচিত্রীকে। নতুন বা সখের আলোকচিত্রী হন বা পেশাদার— ফিল্মটা ডেভেলপ না-হওয়া পর্যন্ত সবারই মনে এক ধরনের অস্বস্তি থাকত। ফটোগ্রাফির গোটা ব্যাপারটা কৌশল আর রাসায়নিকের উপর নির্ভরশীল ছিল। কোথাও একটু তারতম্য ঘটলে ছবির ফলাফলেও তারতম্য হত।

একটি ছোট্ট ঘর, দেওয়াল পর্যন্ত কালো রং, বড় ব়ড় কালো পর্দা— ঘুটঘুটে অন্ধকার। ডার্ক রুম যে কত কত আনন্দের জায়গায় তা বলে বোঝানো যায় না, বারবার বলেন দক্ষ আলোকচিত্রীরা। যেন ঈশ্বরের মতো জন্ম দেওয়া এক নতুন সত্তার।

শহরের কলেজ মোড়ে রয়েছে ‘উর্জ্জনা স্টুডিও’। এই স্টুডিওটি বিজলীবরণ সামন্তের। এখন দেখভাল করেন তাঁর ছেলে সুবীর সামন্ত। সুবীরবাবু বলছেন, “মোবাইলের চল যত বাড়ছে, স্টুডিও ব্যবসা তত বসে যাচ্ছে। অন্যদিকে, এক সময়ের অ্যানালগ ক্যামেরার জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে ডিজিট্যাল ক্যামেরা। অনেক বাড়িতেই ডিজিট্যাল ক্যামেরা রয়েছে।” মোবাইলে ছবি তোলাটাও অনেকের কাছে খুব কঠিন কিছু নয়। কারণ, চোখ আর ইচ্ছেটাই এ ক্ষেত্রে বড় কথা। নাই বা থাকল প্রথাগত পড়াশোনা। আলোকচিত্রীরা জানাচ্ছেন, আলোকচিত্র যখন ক্রমান্বয় সমৃদ্ধ হয়েছে তখন তার মধ্যেও এসেছে নতুনের সন্ধান। মেদিনীপুরের বহু দুর্লভ ছবি ধরা রয়েছে প্রয়াত আলোকচিত্রীদের ক্যামেরায়। ছবিতেও রয়েছে সেই ছাপ।

দিন বদলেছে। বদলেছে সব কিছুই। এখন সোস্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন হাজার ছবি আপলোড হয়। মন চাইলে মোবাইলে ক্লিক। টুকটাক ফোটো এডিট এবং সটান সোশ্যাল সাইটে আপলোড।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement