চন্দনপুরে চলছে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী তৈরির কাজ। ছবি: সোহম গুহ।
এক সময় রামনগর বললেই কাঁসা-পিতল শিল্পের কথাই লোকের মনে হত। শুধু মেদিনীপুর জেলা বা রাজ্য নয়, ভিন রাজ্যেও একসময় ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রামনগর থানার চন্দনপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পের সুনাম ও সুখ্যাতি। বিয়ের দানসামগ্রী, নবজাতকের অন্নপ্রাশন, এমনকী সাংসারিক কাজকর্ম থেকে পুজো-পার্বণে চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে একসময় হিমসিম খেতেন কাঁসা-পিতলের কারিগররা। বর্তমানে অতীতের ঐতিহ্য আর কৌলিন্য কোনওরকমে বজায় থাকলেও নব্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঁসা-পিতল শিল্পের অস্তিত্বও চরম সঙ্কটের মুখে।
সময় বদলেছে। তার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে বদলে গিয়েছে আধুনিকতার সংজ্ঞা। তাই কাঁসা-পিতলের বিকল্প হিসেবে জায়গা দখল করে নিয়েছে ফাইবার, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়ম, কাঁচ, চিনেমাটি ও সিরামিকের তৈরি আধুনিক হাল ফ্যাশনের বাসনপত্র। নব্য আধুনিকতার ধাক্কায় সঙ্কট নেমে এসেছে চন্দনপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পেও। তাই এলাকার প্রায় তিন হাজার কাঁসা-পিতল কারিগর চলে গিয়েছেন বিকল্প জীবিকার সন্ধানে। কেউ পানের বরজ, কেউ একশো দিনের কাজ প্রকল্পে দিন মজুরি করে দিন নির্বাহ করেন। আবার কেউ বা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন অন্য পেশার খোঁজে।
আর বাকিরা অসুবিধা নিয়েও বংশানুক্রমিকভাবে এই শিল্পের সঙ্গে টিঁকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি উদাসীনতা আর মহাজনের কবলে পড়ে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত মজুরি থেকে। এরকমই প্রায় ২০০টি পরিবার এখনও রয়েছে চন্দনপুর গ্রামে। এঁদের মধ্যে দেবাশিস রাণা, ভবতারণ সাউ, শিবরাম মান্না, দীপক সাউ, কালীপদ রাণা, অবন্তী ও কল্যাণী রাণা-সহ আরও অনেকেই কাঁসা-পিতলের সামগ্রী তৈরির কাজে ব্যস্ত। কেউ করছেন বাসন তৈরির মাটির ছাঁচে ঢালাইয়ের কাজ, কেউ করছেন বাসনের চেহারা আনতে পেটাইয়ের কাজ কেউ করছেন বাসনের চাকচিক্য আনতে পালিশের কাজ। তরুণ কারিগর ভবতারণ সাউয়ের কথায়, ‘‘কাঁসা-পিতলের সামগ্রীর ওজন বেশী হওয়া আর দাম বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষ এখন আর কাঁসা-পিতলের দিকে ঝুঁকছেন না। বরং ওজনে হালকা ও দামে সস্তা জিনিসের চাহিদা বাড়ছে।’’
গ্রামের বর্ষীয়ান কারিগর কালীপদ রানা বাসন তৈরি করতে করতে জানালেন, “একসময় কাজের জোগান সামলাতে নাওয়া-খাওয়ার সময়ই পাওয়া যেত না। আর এখন বাজারে চাহিদা না থাকায় কাজ-ই নেই।” কালীপদবাবু রাজ্যের ক্ষুদ্র ও শিল্পাধিকার দফতরের রাজ্য কারুশিল্প প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে একাধিকবার রাজ্য সেরার পুরস্কার জিতেছেন। তার চিহ্ন হিসেবে একাধিক শংসা পত্র বাড়ির দেওয়াল জুড়ে টাঙানো। সেদিকে তাকিয়ে কালীপদ রানার আক্ষেপ, “এখন আর প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে মন টানে না। কী হবে পুরস্কার জিতে? যদি না পেটের ভাতের জোগাড় হয়?’’ চন্দনপুর গ্রামের বাসিন্দা বিদ্যুৎ চৌধুরীর কথায়, ‘‘ মূলধনের অভাবের সুযোগ নিয়ে চন্দনপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পেও ঢুকে পড়েছে মহাজনরা। নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে শিল্পসামগ্রী তুলে নিয়ে বাজারে চড়াদরে বিক্রি করে মুনাফা নিচ্ছে।’’
চাহিদার অভাব আর বঞ্চনার শিকার হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কারিগররা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘চন্দনপুর কাঁসা-পিতল সমাজ কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সমিতি গঠন করেছেন। সমিতির সভাপতি অশ্বিনী কুমার রাণার ক্ষোভ, ‘‘কোনও সরকারই কাঁসা-পিতল কারিগরদের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করেনি। তাই নিজেদের বাঁচাতে নিজেরাই সংগঠন তৈরি করেছি।’’ এই সংগঠনেরই উদ্যোগেকেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কারিগর ও শিল্পীদের পরিচয়পত্র বা ‘আর্টিজেন কার্ড’ আদায় করা গিয়েছে। রামনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নিতাই সারের কথায়, ‘‘চন্দনপুরের কাঁসা-পিতল কারিগররা যাতে ব্যাঙ্ক ঋণ পান তার জন্যও ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে নানারকম উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।”