স্মৃতি: শ্রাবণী ও সৌরভ। দিন কয়েক আগে শ্রাবণীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে তাঁর শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে। ফাইল চিত্র
কাতর ভাবে হাতজোড় করে অনুনয় করছিলেন কুন্তী। বেলপাহাড়ির কুন্তী মাহাতো। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে তাঁর আর্তি, ‘উফ! মাগো তোমরা আমায় আর মেরো না!’ বছর দশেক আগে কুন্তীর বিয়ে হয়েছিল সমীরের সঙ্গে। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী ব্যবসায়ী। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির ভাত কাপড় কোনও দিন সুখের হয়নি কুন্তীর। বিয়ের পরপরই চলত অত্যাচার। কারণ? সেই রবি ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’। কুন্তী নিরুপমার মতোই নিরুপায়।
চাষি পরিবারের মেয়ে। বাপটা খুবই গরিব। তবুও চেষ্টাচরিত্র করে, রীতি রেওয়াজ মেনে বিয়ের দানসামগ্রী, যৌতুক দিয়েছিলেন কুন্তীর বাবা। খরচ প্রায় লাখখানেক টাকা। কিন্তু শাশুড়ি, স্বামীর মন ভরেনি তাতেও। তাদের কাছে বরপণের ৫০ হাজার টাকা কম বলে মনে হয়েছে। বিয়ের পরই হঠাৎ মনে হয়েছে কুন্তীর গায়ের রং শ্যামলা। দেখতেও সুন্দর নয়। অতএব আরও পণের চাপ। রং ফর্সা না হওয়ার মাসুল। সেই মাসুল না পাওয়ায় অত্যাচার। অত্যাচার একদিন চরমে পৌঁছল। পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হল। মাথার চুল আর মুখ মিলিয়ে ২০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা ঠিক সময়ে এসে পড়ায় প্রাণে বাঁচে কুন্তী।
হঠাৎ কুন্তীর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল শ্রাবণীর জন্য। খড়্গপুর ২ ব্লকের সরোই গ্রামের শ্রাবণী বেরা মাইতির সঙ্গে চকরামপুরের সৌরভের বিয়ে হয়। কুন্তীর মতোই বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা হঠাৎ আবিষ্কার করেছিল, শ্রাবণীর গায়ের রং কালো। ফলে অত্যাচার। মাত্রা বাড়তে বাড়তে একদিন পুড়ে মৃত্যু হল শ্রাবণীর। তাঁর দাদার অভিযোগ, বোনকে পুড়িয়ে মেরেছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
শ্বশুরবাড়িতে মেয়েদের অত্যাচারিত হওয়ার বহুবিধ অজুহাত। সেই কবে থেকে সেসব অজুহাত আবিষ্কার করে চলেছে শ্বশুরবাড়ির উর্বর মস্তিষ্কের মানুষগুলো। আগে মেয়ে ‘পার’ করানোর জন্য বাবা-মা মেয়েকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখাতেন। একটু নাচ, শুক্তো রান্না বা কই মাছ কাটায় পারঙ্গমতা দেখাতেই হতো। সেসব দিন গিয়াছে। এসেছে অন্য অজুহাত। গায়ের রং কালো, দাঁত উঁচু, দেখতে ভাল নয়ের মতো নানা মাপকাঠি শ্বশুরবাড়ির লোক বিয়ের পরে বার করে থাকে। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ছেলের বিয়ে বাবা-মা দেখাশোনা করেই দিয়েছেন। এর কারণ কী? উত্তর নেই। তখন কি মনে হয় না, ইচ্ছে করেই ‘খুঁত’ দেখেই কোনও মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনা হয়? যাতে ওই ‘খুঁত’গুলোর জন্য চাপ দিয়ে বারবার পণ আদায় করা যায়।
না হলে পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে কেন বাপের বাড়ি ফিরে আসতে হয় নিয়তিকে? ঝাড়গ্রামের নিয়তি প্রামাণিক। বিয়ে হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে। বাড়ির লোক বেশি পণ দিতে পারেনি। ফলে তাকে মেয়ে নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে দাদাদের সংসারে। নিয়তি যদি নিজেকে অন্যের সংসারে ‘বোঝা’ বলে মনে করেন তাহলে কি সেই মনে করায় খুব ভুল হবে!
শুধু কি গায়ের রং বা পণের কারণেই মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হতে হয়? আরও কত কারণ থাকে। এই যেমন ঝাড়গ্রামের বাঁশপাহাড়ির তড়িতা মণ্ডল। স্বামী সরকারি চাকুরিজীবী। তড়িতা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। কিন্তু বছর পাঁচেক ধরে সে শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের শিকার। শাশুড়ির সঙ্গে স্বামীও তাঁকে অত্যাচার করেন। একটা কারণ, তড়িতা অসুন্দর। দ্বিতীয় কারণ তিনি পড়তে চেয়েছিলেন। তার ফল হল আরও মারাত্মক। একদিন শ্বশুরবাড়ির লোক তাঁর বই-খাতা সব পুড়িয়ে দিল। দিনের পর দিন তড়িতাকে ঘরে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হত। খেতে দেওয়া হত না। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে অঙ্গনওয়াড়িতে আসতে দিত না। এখন তড়িতা বাপের বাড়িতে। সেখান থেকেই অঙ্গনওয়াড়িতে যায়। চাকরি বজায় রেখে নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। পড়তে চেয়ে পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই গুলি খেয়েছিল। আর ঝাড়গ্রামের তড়িতা পড়তে চেয়ে সংসার হারায়।
কুন্তী, শ্রাবণীদের উদাহরণ তো প্রচুর দেওয়া যায়। দেওয়া যায় পরিসংখ্যানও। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য ঘাঁটলে প্রতি বছর বধূ নির্যাতন এবং নির্যাতনের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। কেন এখনও পণ এবং অন্যান্য দাবিতে এত সংখ্যক মেয়ের মৃত্যু হয়? মেয়েদের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য, তাঁদের সামাজিক ভাবে এগিয়ে আনার জন্য সচেতনতা প্রচারের অভাব নেই। কেন্দ্র এবং রাজ্য নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছে। আইনও বেশ কড়া। তবুও কেন মাঝে মাঝেই শ্রাবণীদের প্রাণ দিতে হবে? বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের নানা সমস্যা নিয়ে দুই মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম, তিন জেলাতেই কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এর দায় কিন্তু কিছুটা নিতে হবে মেয়ের বাবা-মাকেও। যে পরিবার পণ এবং দান সামগ্রীর জন্য বারবার অসৌজন্যমূলক ভাবে দাবি করে সেখানে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি নেওয়া হবে কেন? বিয়ের পরে মেয়েটি যখন ‘সামাজিক ভাবে আটকা পড়ে’ যায় তখন তো সেই দাবি বাড়তে পারে? যে পাত্রপক্ষ মেয়ের গায়ের রং নিয়ে পণের জন্য দর কষাকষি করে তারা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর হবে। চারপাশের উদাহরণ থেকেই তো সেই শিক্ষা মেলে? তবুও কেন? সেটা কি শুধু মেয়েকে ‘পার’ করার জন্য? এই মনোভাবও কিন্তু মেয়েদের পক্ষে সম্মানজনক নয়।
এর আগে বহুবার লেখা হয়েছে। পরিস্থিতি রাতারাতি বদলানোর কোনও আশা নেই। হঠাৎ করে কু-মানসিকতার শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা ভাল হয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কাও কম। সুতরাং আবারও লিখতে হবে কোনও কুন্তীর কথা, শ্রাবণীদের কথা। কেন এমন জীবনহানি? লিখতে গিয়ে আবার বলতে হবে, এই সমাজে এখনও পাত্রপক্ষ জীবিকা অনুযায়ী ছেলেকে নিলামে তোলে। পাত্র রিকশাওয়ালা হলে ২০-৩০ হাজার টাকা, সরকারি চাকুরিজীবী হলে ৩-৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয় মেয়ের বাড়ির কাছ থেকে। বিবাহ নামক সুন্দর বিষয়টিকে বিক্রেতা-উপভোক্তার সম্পর্কে আনা যায় কি?
এই বিষয়টি কিন্তু এ যুগের রামসুন্দরদের ভেবে দেখতে হবে। ‘পণ নেব না’র মতো উদারতা আরও বেশি ছড়িয়ে পড়াটা খুব জরুরি। কিন্তু ‘পণ দেব না’র মত দৃঢ়তাও দেখাতে হবে রামসুন্দরদের। মেয়ের বিয়ে না হলে বাবা-মাকে মানসিক চাপে পড়তেই হয়। সে কথা স্বীকার করে নিয়েই বলছি। ‘উফ! মাগো তোমরা আমায় আর মেরো না!’— এই আর্তি যে বড্ড বেশি বেদনাদায়ক!
লেখক সমাজকর্মী