সংরক্ষণের জায়গা নেই। রাস্তাতেই আনাজের পাইকারি বিকিকিনি। দাসপুরে। ছবি: কৌশিক সাঁতরা
রাজ্যে যে দলের সরকার থাকে দাসপুর থাকে তার বিপরীতে। লোক মুখে এ কথাও প্রচলিত রয়েছে ‘দাসপুর ভাল জল মাপতে পারে।’ এ বার লোকসভা ভোটেও কি একই প্রবণতা বজায় থাকবে? মন বুঝতে মরিয়া রাজনৈতিক দলগুলি।
১৯৯৮ সাল। দাসপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতি বামেদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। ২০০১ এর বিধানসভা ভোটেও দাসপুর কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন তৃণমূলের অজিত ভুঁইয়া। এক যুগ পরেও বজায় ছিল একই প্রবণতা। ২০১৩ সাল। রাজ্যে পরিবর্তনের পর পঞ্চায়েত ভোট। ওই আবহেও দাসপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতি এবং তার অন্তর্গত গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রভাব দেখিয়েছিল বামেরা। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটেও জোটপ্রার্থী প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। আশায় আছে বিরোধীরা। যদিও শাসক শিবিরের ব্যাখ্যা, দাসপুর স্রোতের বিপরীতে হাঁটে ঠিকই, কিন্তু পালাবদলের পর সে ভাবে সুবিধা করে উঠতে পারেনি বিরোধীরা। কারণ, ভোট পেলেও বিরোধীরা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা দখলের জায়গায় যায়নি।
তা হলে কি দাসপুর এখন ‘স্বস্তি’তে শাসকের পাশে থাকছে? ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত দাসপুর বিধানসভা এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে কিন্তু উঠে এল আশা পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ। দাসপুর মানেই সোনা। এখানকার কারিগরদের কদর ভিন রাজ্যেও যথেষ্ট। কিন্তু নোটবন্দি এবং জিএসটি ধাক্কা দিয়েছে সোনার তালুকেও। ক্ষমতায় এলে দাসপুরে সোনার হাব করা হবে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৎকালীন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাব হয়েছে। তবে তা তামার। ক্ষুব্ধ এক সোনার কারিগর তো বলেই ফেললেন, ‘‘এ যেন নাকের বদলে নরুণ।’’ তামার হাব যে সোনার হাবের যে বিকল্প নয়, দলের অন্দরে তা মানছেন তৃণমূল নেতারাই। শুধু সোনা নয়। দাসপুরের পরিচিতি আনাজ ও ফুল চাষে। এই জনপদের দীর্ঘদিনের দাবি, আনাজ সংরক্ষণ কেন্দ্র। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা শুধু প্রতিশ্রুতিতেই রয়ে গিয়েছে। স্থানীয় ফুল চাষি নিমাই বাগ বলেন, ‘‘সংরক্ষণ কেন্দ্র দূরের কথা, এখানে ফুল ও আনাজের কোনও আড়তও তৈরি হয়নি। ফড়েদের উপরেই ভরসা করতে হয়। ’’ গত পাঁচ বছরে দাসপুরে শহরের একটা অংশে সাংসদের টাকায় পথবাতি বসেছে। এ ছাড়াও স্কুল-আইসিডিএস বিল্ডিং সংস্কার ছাড়া তেমন কিছু কাজও হয়নি। ভোটে জেতার পর বন্যার সময় বাদে এলাকার সাংসদ দাসপুর পা দেননি।
না পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ। তবে পাওয়ার তালিকাটাও খুব ছোট নয়। কলমীজোড়ে কংসাবতী নদীর উপর ডেবরার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির জন্য সেতু হয়েছে। যশোড়া সেতুর কাজও শুরু হয়েছে। জোতঘনশ্যামে আইটিআই কলেজ এবং পলাশপাই খাল সংস্কার হয়েছে। এ ছাড়াও রাস্তাঘাট, সেচ, শিক্ষার পরিকাঠামোর প্রভূত উন্নতি হয়েছে। তৃণমূলের দুই ব্লক সভাপতি আশিস হুতাইত এবং সুকুমার পাত্র বললেন, “তৃণমূল ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেয় না। একটু দেরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কথা যখন দেওয়া হয়েছে সোনার হাব ও আনাজ সংরক্ষণ কেন্দ্র হবেই।” বিজেপি নেতা তপন মাইতি বলছেন, “হচ্ছে হবে করে একের পর এক ভোট কাটিয়ে দেওয়ায় তৃণমূলের কাজ। যে দাসপুর তৃণমূলের একেবারে শুরু থেকে সঙ্গ দিয়েছে সেই দাসপুর ঘুরে দেখলেই বোঝা যায় পরিকাঠামোয় সাবির্ক ভাবে কতটা পিছিয়ে।”
পালাবদলের পর থেকে বিরোধীরা দাসপুরে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও আঁচড় কেটেছে বরাবরই। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে দাসপুর বিধানসভায় তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৩.৪৯শতাংশ। ২০১৬ সালের বিধানসভায় ভোটে দাসপুর বিধানসভায় তৃণমূল পেয়েছিল ৫৩.৩৩ শতাংশ। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৭.২৩ শতাংশ। ২০১৬ সলের বিধানসভা ভোটে দাসপুরে বিজেপির ভোট ছিল ৫.৯২শতাংশ। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে বামেদের ভোট ছিল ৩৪.৮৮শতাংশ। ২০১৬ সালে বিধানসভায় ভোটে দাসপুরে জোটপ্রার্থী পেয়েছিলেন ৩৯.৮৪ শতাংশ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে অনেকটা পিছিয়ে থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি। যদিও গেরুয়া নেতৃত্বের দাবি, গত তিন বছরে দাসপুরের প্রেক্ষাপট বদলেছে অনেকটাই। তাঁদের দাবি, বাম ভোটে ভাগ বসাবেন তাঁরা। তৃণমূলের দাবি, দাসপুর তাদের সঙ্গেই থাকবে। দাসপুর বিধানসভায় দু’টি ব্লক। দাসপুর-১ ও দাসপুর-২। দাসপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির ৩৪টি আসন দাসপুর বিধানসভা এলাকায়। সবক’টি তৃণমূলের। দাসপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূল ৩৬টি এবং সিপিএম ৩টি আসন দখল করেছে। দাসপুর বিধানসভা এলাকায় ২০টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। সবক’টি শাসক দলের দখলে রয়েছে।
দাসপুর কি এ বারও জল মাপবে? বুঝতে মাথার ঘাম পায়ে
ফেলছেন প্রার্থীরা।