এক বছর আগে ছবিটা ছিল অনেকটা আলাদা। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তমলুক পুরসভা এলাকার ২০ টি ওয়ার্ডের সবক’টিতেই ভোটের ব্যবধানে বামফ্রন্টের প্রার্থীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল তৃণমূল। বছর ঘুরতেই, এ বার পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূল চারটি ওয়ার্ডে পিছিয়ে রয়েছে বিরোধীদের থেকে।
আর বামেদের অবস্থা তো শোচনীয়। গত বারের তিনটি আসন হারানোর পাশাপাশি বিপুল ভোট বিপর্যয়ের মুখে বামেরা। ফলে পুরসভায় বিরোধী দলের ভূমিকাও হারিয়েছে বামফ্রন্ট। উল্টে পুর-নির্বাচনে তৃণমূলকে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে প্রধান বিরোধীর জায়গা ছিনিয়ে নিয়েছে নির্দলরা।
পুরসভা ভোটের ফল অনুযায়ী, ২০ ওয়ার্ডের তমলুক পুরসভায় এ বার ভোটার সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬২। এঁদের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৪২ হাজার ৩৩৪ জন। অর্থাৎ ভোট পড়েছে ৮৯.৩৮ শতাংশ। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে তৃণমূল প্রার্থীরা পেয়েছেন মোট ২০ হাজার ১৮৭ টি ভোট। অর্থাৎ ৪৭.৬৮ শতাংশ। পুরসভার ১৬ টি আসনে জিতে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তৃণমূল। বিরোধীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী তিনটি আসন জিতেছেন নির্দল প্রার্থীরা। আর বিজেপি পেয়েছে একটি আসন। শুধু আসন সংখ্যার নিরিখে নয়, বিরোধীদের মধ্যে এ বার সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা। পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নির্দল প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট ভোটের সংখ্যা ১২ হাজার ১৩৩। অর্থাৎ ২৮.০৬ শতাংশ ভোট। পুরসভায় জেতা নির্দলদের তিনটি আসনের মধ্যে দু’জনই সিপিএমের বহিষ্কৃত নেতা লক্ষ্মণ শেঠের নেতৃত্বাধীন ভারত নির্মাণ পার্টির সমর্থিত প্রার্থী। আর তাতেই অস্বস্তি বেড়েছে গতবার পুরসভায় বিরোধী দল সিপিএমের। এরপরই বিরোধী হিসেবে স্থান বিজেপির। পুরসভার ১৬ টি ওয়ার্ডে দলীয় প্রতীকে দাঁড়ানো বিজেপি প্রার্থীরা পেয়েছে মোট ৫৮৭৮ টি ভোট অর্থাৎ ১৩.৮৮ শতাংশ ভোট। গত বছর লোকসভা ভোটের তুলনায় এ বার পুরসভায় প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ বেশ কিছুটা বেশিই।
তবে এ বার পুরভোটে একেবারেই হালে পানি মেলেনি বামেদের। গত পুরবোর্ডে বিরোধী আসনে থাকা বামেরা এ বার একটি আসনেও জিততে পারেনি। উপরন্তু এবার পুরসভা নির্বাচনে তমলুকে কার্যত ভোট বিপর্যয় ঘটেছে বামেদের। পুর-নির্বাচনে ১৬ টি আসনে নিজেদের দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দিয়ে বামফ্রন্টের মোট প্রাপ্ত ভোট ২৬৯০ টি। অর্থাৎ পুরসভায় মোট প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৬.৩৫ শতাংশ। গতবারের চেয়ে এ বার শুধু পিছিয়ে পড়াই নয় বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভোট প্রাপ্তির নিরিখে পুরসভার ১৬ জন বামফ্রন্ট প্রার্থীর মধ্যে ১২ জনের জামানত জব্দ হয়েছ। ১৬ টি ওয়ার্ডের ১১ টি ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট ১০০ টিরও কম করে।
কিন্তু কেন এমন বিপর্যয়?
সিপিএমের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহির স্বীকারোক্তি, ‘‘তমলুক পুরসভা এলাকায় আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। তাছাড়া দল থেকে লক্ষ্মণ শেঠের বহিষ্কারের জেরে সমর্থন কিছুটা হলেও কমেছে। তবে দলের জনসমর্থনে ঘাটতির আরও কিছু কারণ রয়েছে। যার সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে পুর-নির্বাচনে।’’
তবে শহরের সিপিএম কর্মীদের একাংশের মতে, শহরের উন্নয়নে তৃণমূল বোর্ডের ব্যর্থতা নিয়ে বামেদের তরফে কোনও জোরদার আন্দোলন হয়নি। এছাড়াও তৃণমূল পুরবোর্ড বিভিন্ন কাজে নানা অনিয়ম করা সত্ত্বেও বিরোধী দল হিসেবে বামেরা সরব হননি। ফলে শহরের বাসিন্দারা ক্রমশ মুখ ফিরিয়েছেন। আর তার জেরেই এমন বিপর্যয়।
তমলুক পুরসভা নির্বাচনে বামেদের বিপর্যয়ের কারণ প্রসঙ্গে লক্ষ্মণ শেঠ অবশ্য বলেন, ‘‘সিপিএম পার্টি যে নীতি-আদর্শ নিয়ে চলেছে তা আজকের যুগোপযোগী নয়। এতটা বিপর্যয়ের জন্য দলীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা দায়ী। তবে এটাও অনস্বীকার্য, তমলুক শহরের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয়তাবাদী ঘরানার। তাঁরা কোনদিনই সিপিএমকে গ্রহণ করেনি। এমনকি আমি তমলুকের সাংসদ থাকার সময়ও তমলুক শহরের বাসিন্দারা কংগ্রেস বা তৃণমূলকে সমর্থন করে পুরসভা নির্বাচনে জিতিয়েছে।’’