জড়ানো পট।
আঙ্গিক, নাকি বিষয়বস্তু— কীসের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকসঙ্গীতের সংজ্ঞা? এই প্রশ্নই উস্কে দিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ছাত্র-যুব উৎসবের মঞ্চ।
কাঁথিতে আয়োজিত ওই উৎসবের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া এক পটশিল্পী দলের অভিযোগ, সাম্প্রতিক বিষয় নির্বাচন করায় তাঁদের পটের গানকে লোকসঙ্গীত নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বিচারক। প্রতিযোগিতা থেকে তাঁদের বাদও দেওয়া হয়েছে। ওই শিল্পীরা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার যুব আধিকারিকের কাছে লিখিত অভিযোগও জানিয়েছেন।
জেলার ছাত্র-যুব উৎসব উপলক্ষে গত ১ ফেব্রুয়ারি কাঁথির প্রভাত কুমার কলেজের মাঠে ওই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সঙ্গীত বিভাগে বিষয়বস্তু ছিল ‘জেলাগত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন লোক গান’। সেখানে যোগ দেয় মহিষাদল, নন্দকুমার এবং চণ্ডীপুরের লোক শিল্পীদের তিনটি দল। চণ্ডীপুরের পটশিল্পী আবেদ চিত্রকরের স্ত্রী সায়েরা চিত্রকরের দল পটের গানে পথ নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছিল। আবেদের অভিযোগ, গান শেষ হওয়ার আগেই বিচারকেরা থামিয়ে দেন। জানান, এটি লোকগান নয়।
সে দিন বিচারকের আসনে ছিলেন কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজের সঙ্গীত বিভাগের প্রধান মৌমিতা চক্রবর্তী। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘একটি নির্দিষ্ট এলাকার সামাজিক এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয় লোকসঙ্গীতে। তা পরিবেশনের নির্দিষ্ট আঙ্গিক রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে গান পরিবেশন করা হয়েছে, তা ঐতিহ্যবাহী নয়। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতেই এই গান বাঁধা হয়েছে। তাই এই গানটিকে লোকসঙ্গীত বলে আপাতভাবে মনে করা হয়নি।’’ তবে ওই পটুয়া দলকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গে মৌমিতার বক্তব্য, ‘‘প্রতিযোগীদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি জানা নেই।’’
সায়েরার স্বামী আবেদ বলেন, ‘‘প্রচলিত একটি বিষয় পটের গানের আঙ্গিকে পরিবেশন করা হয়েছিল। ওই গানে রাজ্য সরকারের পথ নিরাপত্তা প্রকল্পের কোনও শব্দ ব্যবহার হয়নি। আর পটের গানকে পুরোপুরি জেলাগত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন লোকসঙ্গীত বলেই মনে করা হয়। কিন্তু তাও ওই গানটি বিচার প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হল।’’
তবে কি দীর্ঘ দিন ধরে যে সব পুরাণকথা ভিত্তিক পটের গান পরিবেশিত হচ্ছে, তার আঙ্গিক এক রেখে নতুন বিষয়বস্তু নির্বাচন করলেই তা আর লোকসঙ্গীত থাকে না?
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামতও দ্বিধাবিভক্ত। পটশিল্প এবং পটের গান নিয়ে গবেষণা করছেন সুহৃদকুমার ভৌমিক। তাঁর মতে, ‘‘পটের গান অবশ্যই লোকসঙ্গীত। আর্থ-সামজিক প্রেক্ষাপটে পটুয়ারা প্রাচীন বিষয় বাদ দিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটেও গান বাঁধেন। ছবি আঁকেন। তবে তার আঙ্গিক সেই পুরনো ধাঁচেই থাকে। ফরাসি বিপ্লব নিয়েও তো পটের গান রয়েছে।’’ সুহৃদের মতে, সময়ের সঙ্গে পটুয়াদের নতুন বিষয় ভাবতেও হবে। না হলে তাঁদের রুটিরুজি মার খাবে। আর আর্থিক কারণে পেশা পরিবর্তন করলে ওই গানও হারিয়ে যাবে। পটের গানের আর এক গবেষক দীপক বরপন্ডা আবার বলছেন, ‘‘লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু ঐতিহ্যবাহী হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’’
অনেকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে কন্যাশ্রী থেকে শ্রমিক মেলা— বিভিন্ন প্রকল্প প্রচারেও তো পটের গান ব্যবহার করা হচ্ছে।
আবেদও পুরনো আঙ্গিক বজায় রেখে নতুন বিষয় নির্বাচনেরই পক্ষে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই একই বিষয়ে গান গেয়ে এই একই প্রতিযোগিতায় দু’বছর ধরে পুরস্কার পেয়েছি। তা হলে আগে কেন বাদ দেওয়া হয়নি!’’ পাশাপাশি, তাঁর অভিযোগ, ‘‘বিচারকেরা জেলা গত বৈশিষ্ট্যের কথা বলছেন। অথচ প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া ঝুমুর গান তো এই জেলার লোকগীতি নয়!’’