আঙুলের ছাপ দিয়েই বিক্রি করতে হচ্ছে ধান। —নিজস্ব চিত্র।
শুধু কী সরষে! ভূত থাকে ধানের মধ্যেও। বিশেষ করে সরকারের ধান কেনার সময় হলে হাজির হয় ভূতুড়ে চাষিরা। সেই ভূতদের আটকাতে রাজ্য সরকার ভরসা করছে আধার কার্ডের উপরেই। এ বার থেকে বায়োমেট্রিক তথ্য না মিললে চাষি সরকারি ধানক্রয় কেন্দ্রে তাঁর ধান বিক্রি করতে পারবেন না। সরকারি প্রকল্পে ভর্তুকি মেলার ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক করেছে কেন্দ্র। রাজনৈতিক ভাবে এতে আপত্তি রয়েছে তৃণমূলের। তবে আপত্তি থাকলেও বহু ক্ষেত্রে আধারকে মান্যতা দিয়েছে রাজ্যও। এ বার তাতে যুক্ত হল চাষিদের থেকে সহায়ক মূল্যে ধান কেনাও। প্রশাসনের অন্দরের খবর, মূলত ফড়েরাজ আটকাতেই চলতি বছর থেকে ধান কেনার ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চাষিরা যাতে ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন, তার জন্য সরকারি ভাবে ধান কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগেই। আগে নানা পরিস্থিতিতে কার্যত বাধ্য হয়ে ফড়েদের কাছে ধান বিক্রি করতেন চাষিরা। বাজারের চেয়ে অনেক কম দাম দিতেন ফড়েরা। তাই ফড়েদের আটকে চাষিদের সুরাহা দিতে বাজারের চেয়ে বেশি দামে সরাসরি ধান কেনার জন্যই চালু হয়েছে ধান ক্রয়কেন্দ্র। এখানে চাষিরা সহায়কমূল্যে ধান বিক্রি করেন। বর্তমানে ফড়েদের কাছে বিক্রি করলে কোনও চাষি প্রতি কুইন্টাল ধানের বাবদ ১৯৫০ টাকা পান। কিন্তু চাষিদের থেকে প্রতি কুইন্টাল ২১৮৩ টাকা দরে ধান কিনছে সরকার। তার সঙ্গে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে পরিবহণ খরচ বাবদ কুইন্টাল প্রতি আরও ২০ টাকা দেওয়া হচ্ছে।
বাজারের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে। আলাদা করে উৎসাহ ভাতা দিয়েও আটকানো যাচ্ছিল না ফড়েরাজ। কুপন নামক ছিদ্রপথে বেহুলার লৌহবাসরে ঢুকছিল ফড়েরা। কী এই কুপন? এতদিন নিয়ম ছিল, ধান বিক্রয়ে আগ্রহী চাষিদের নানা তথ্য (আধার নয়) দিয়ে প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করাতে হত। বিনিময় মিলত কুপন। সেই কুপনে তারিখ ও ধান বিক্রির পরিমাণ উল্লেখ থাকত। পরে সেই কুপন নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ধান বিক্রি করা যেত। অভিযোগ উঠত, চাষিদের থেকে কম দামে ধান কিনে এক শ্রেণির ফড়ে ওই কুপন সংগ্রহ করতেন। পরে নির্দিষ্ট দিনে ওই কুপন দেখিয়ে বেশি দামে সেই ধান বিক্রি করতেন। অভিযোগ, এটা অবশ্য ধান দুর্নীতির প্রাথমিক কৌশল। এ ছাড়াও ছিল নানা ফিকির।
খাদ্য দফতর জানাচ্ছে, নয়া ব্যবস্থায় চাষিদের কাছ থেকে চারটি তথ্য নেওয়া হচ্ছে। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং কৃষক বন্ধু বা জমির রেকর্ড। ওইসব নথি দেখিয়ে আগে ধান ক্রয়কেন্দ্রে এসে নাম নথিভুক্তি করছেন চাষিরা। রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পরই চাষির যাবতীয় তথ্য মজুত হয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট দিনে চাষিরা ধান নিয়ে আসার পরও থাকছে নানা নিয়ম। আগে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট চাষির বায়োমেট্রিক ছাপ মেলার পর শুরু হচ্ছে ধান কেনার প্রক্রিয়া। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা খাদ্য আধিকারিক অরিন্দম সরকার বলেন, ‘‘এ বার বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ধান কেনা হচ্ছে। একশো শতাংশ চাষি সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে এসে ধান বিক্রি করছেন। কৃষকরা খুশি মতো ধান বেচছেন।"
দাসপুর ১ ব্লক অফিসের পাশেই রয়েছে ধান ক্রয়কেন্দ্র। প্রায় প্রতিদিন সকাল ১০টা হতে না হতেই ভিড় জমছে সেখানে। গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে ধান। চাষিরা প্রয়োজনীয় কাজ সেরে অপেক্ষা করছেন। বায়োমেট্রিক মিলিয়ে কেনা হচ্ছে ধান। প্রাথমিক ভাবে এই নয়া পদ্ধতিতে চাষির ধান একমাত্র তাঁরাই বিক্রি করতে পারবেন। চাষির ধান কোনও ভাবেই অন্য কেউ বিক্রি করতে পারবেন না। এমনকি, সংশ্লিষ্ট চাষি পরিবারে যার নামে নথিভুক্তি, তিনিই একমাত্র ধান বিক্রি করতে পারবেন। বাড়ির অন্য কোনও সদস্যও ধান বিক্রি করতে পারবেন না। এই নিয়ে আলাপ-আলোচনাও শোনা গেল চাষিদের মধ্যে। তবে সার্বিক ভাবে খুশিই চাষিরা। দাসপুরের গোপীনাথপুরের কাশীনাথ জানা বলছিলেন, “এটা খুব ভাল সিস্টেম। আগে কুপন নিয়ে এসে যে কেউ ধান বিক্রি করতে পারতেন। এখন সেটা হচ্ছে না। ফড়েদের আটকাতে এই ব্যবস্থা জরুরি ছিল।” ঘাটাল মহকুমা খাদ্য নিয়ামক নন্দ দাস বলছিলেন, "ঘাটাল মহকুমার পাঁচটি ব্লকে পুরোদমে ধান কেনা চলছে। চাষিদেরও আগ্রহ বাড়ছে। দিনের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ধান নেওয়া হচ্ছে।
রেশন বণ্টন দুর্নীতিতে এখন জেলবন্দি প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। আর তারপরই খাদ্য দফতরের একের পর এক দুর্নীতি সামনে এসেছে। দুর্নীতিতে জড়িতেরা গ্রেফতার হচ্ছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে। তৎপরতা বেড়েছে তদন্তকারী সংস্থার। ঘটনাচক্রে এই আবহে চলতি মরসুমে ধান বিক্রয় কেন্দ্রে যাবতীয় ‘দুর্নীতি’ কিম্বা ফঁড়েদের দাপট ঠেকাতে সক্রিয় হল খাদ্য দফতর।
ভোটের ময়দানে ম্যাজিক দেখিয়েছে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প। কৃষকের ঘরে ধানই লক্ষ্মীর ভান্ডার। তাই রাজনৈতিক ভাবে যতই আপত্তি থাক না কেন ধানে আঁধার কাটাতে রাজ্যের ভরসা সেই আধারই। আর লোকসভা ভোটও তো হাজির দুয়ারে।
(চলবে)