ভাসাইলি রে। ঘাটাল শহরের আড়গোড়া এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
শঙ্কা ছিলই। আর তা সত্যি করে বর্ষার চেনা চেহারায় ফিরল ঘাটাল। জলাধারের ছাড়া জল এবং অতিভারী বৃষ্টিতে ঘাটাল মহকুমার একাংশে বানভাসি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, দাসপুরের কাছে শিলাবতী নদীর জল বইছে বিপদসীমার উপরে। বিপদসীমা যেখানে ৯.২৯ মিটার, সেখানে শিলাবতীর জলস্তর ছুঁয়েছে ৯.৩৬ মিটার। দাসপুরের নাড়াজোলে ও সেকেন্দারি গ্রামে জলে ডুবে দু’জনের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।
শুক্রবার সারা রাত এবং শনিবারও দিনভর পশ্চিম মেদিনীপুরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। সর্বাধিক বৃষ্টি হয়েছে ঘাটালেই। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এ দিন সকালে বিভিন্ন জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ে ‘ভিডিও কনফারেন্স’ করেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা, জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ, দুর্যোগ মোকাবিলা দফতরের জেলা আধিকারিক সত্যব্রত হালদার প্রমুখ। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, আজ, রবিবার জলমগ্ন এলাকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে জেলায় আসার কথা পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, ‘‘পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছু এলাকায় নৌকায় চলাচল শুরু হয়েছে। নৌকোয় যাতে বাড়তি যাত্রী না ওঠে, সে দিকে নজর রাখা হয়েছে।’’
শনিবার সকালে দাসপুরের চণ্ডীপুরে জলের তো়ড়ে তলিয়ে যান এক মহিলা। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃত দুর্গা দাস (৫৬) নৌকো করে গরু খুঁজতে গিয়েছিলেন। নৌকো উল্টে গিয়ে জলে তলিয়ে যান তিনি। স্থানীয়রাই তাঁকে উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন বিডিও রোশনি সরকার, দাসপুরের বিধায়ক মমতা ভুঁইয়া। আবার এ দিন জলের তোড়ে তলিয়ে মৃত্যু হয়েছে আরও এক শিশুর। দাসপুর-১ ব্লকের সেকেন্দারি গ্রামের ওই শিশুর নাম সুপ্রিয়া পাঠক (২)। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, হামাগুড়ি দিতে দিতে ওই শিশুটি বাড়ির সামনের মাঠে চলে যায়। সেখানেই এক গলা জলে ড়ুবে মৃত্যু হয় তার।
ঘাটাল ব্লকের ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টি পঞ্চায়েত এলাকা জলমগ্ন। দাসপুর-১ ব্লকের নাড়াজোল ও রাজনগর দুই গ্রাম পঞ্চায়েত জলের তলায়। ঘাটাল ব্লকের খালিসাকুণ্ডু, জয়বাঁধ, বাড়গোবিন্দ, চৌকা, দৌলতচক, নিমপাতা-সহ ৮০টি গ্রাম জলমগ্ন রয়েছে। এ দিকে দাসপুর-১ ব্লকের নাড়াজোল ও রাজনগর দুই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার দানিকোলা, কাঁটাদরজা, চণ্ডীপুর, রায়কুণ্ডু, হোসেনপুর-সহ ২৫টি গ্রাম পুরো জলের তলায়। দুর্যোগের জেরে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে ঘাটালে। রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে চন্দ্রকোনা-ঘাটাল রাজ্য সড়ক এবং ভাদুতলা-রোড চন্দ্রকোনা জাতীয় সড়কে। এই পরিস্থিতিতে ঘাটাল শহরের ২ নম্বর চাতালে নৌকোয় করে চলছে যাতায়াত। সরকারি তরফে রয়েছে ১৬টি সরকারি নৌকোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে শুধু সেটুকুই নয়, রয়েছে আরও ৫০-৬০টি নৌকোর ব্যবস্থা।
ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ না কমানোয় এবং ভারী-অতিভারী বৃষ্টি চলতে থাকায় ঘাটাল নিয়ে উদ্বেগ দূর হচ্ছে না প্রশাসনের একাংশের। কারণ, ডিভিসির ছাড়া জল এক সময় শিলাবতীতে এসেই মেশে। জেলার মধ্যে সব থেকে বেশি বৃষ্টিও হয়েছে ঘাটালে, ১৪১ মিলিমিটার। মেদিনীপুরে ১০০ মিলিমিটার, ঝাড়গ্রামে ৪৬ মিলিমিটার, সবংয়ে ৬২ মিলিমিটার, পিংলায় ৯২ মিলিমিটার। পশ্চিম মেদিনীপুরে সার্বিক বৃষ্টিপাতের গড় ৭৭ মিলিমিটার।
মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘাটাল মহকুমায় প্রায় দু’হাজারের বেশি কাঁচা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে দেড় হাজারের বেশি বাড়ির। ঘাটাল ব্লকের সুলতানপুর পঞ্চায়েতের খালিসাকুণ্ডুতে ২টো ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। খালিসাকুণ্ডুর রাম কারকের কথায়, ‘‘নিজের বাড়ি-ঘর তো সব জলে ডুবে গিয়েছে। এখন ভরসা শুধু এই শিবিরটাই।’’ ঘাটালের মহকুমাশাসক রাজনবীর সিংহ কপূর বলেন, ‘‘জলস্তর বিপদ সীমা ছাড়িয়েছে। দু’টি ত্রাণ শিবির
খোলা হয়েছে।’’
ঘাটালের পরিস্থিতির কি আরও অবনতি হতে পারে? দুর্যোগ মোকাবিলা দফতরের জেলা আধিকারিক সত্যব্রত হালদারের জবাব, “ঘাটালে সবথেকে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। নদীতে ভাল জলও রয়েছে। পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখা হয়েছে। একটানা ভারী বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’’
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল, নিজস্ব চিত্র।