চালকের আসনে। নিজস্ব চিত্র।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেকটা সময় পেরিয়েছে। বেড়েছে বয়সও। কিন্তু আট বছর পরও পত্নী-বিয়োগের যন্ত্রণাটা সামলে উঠে পারেননি তিনি। অবস্থা বুঝে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের সঙ্গে মেলামেশার পরামর্শ দিয়েছিলেন এক মনোবিদ-চিকিৎসক। তারপর থেকে একটি টোটোকেই মন খারাপের ‘দাওয়াই’ বানিয়ে ফেলেছেন ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী উমা গুপ্ত। ৬৬ বছরের উমা গত পাঁচ বছর ধরে দাপিয়ে টোটো চালাচ্ছেন অরণ্যশহরে। আর
এতেই তাঁর আনন্দ! অনেক ক্ষেত্রে ভাড়া না নিয়েই যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন উমা।
উমার জন্ম অরণ্যশহরে। সত্তরের দশকে মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্টেট ব্যাঙ্ক, ঝাড়গ্রাম শাখায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর পদে চাকরি পান। তারপরে বিয়ে করেন ঘাটশিলার মুশাবনির সুদেবীকে। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে উমার চাকরি স্থায়ী হয়। এক ছেলে, এক মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল উমার। ছেলে হরিশ্চন্দ্র এখন উমার ব্যাঙ্কেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্ত্রী ও পরিজনদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য ২০০৬ সালে স্বেচ্ছাবসর নেন উমা। কিন্তু ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে হৃদ্রোগে প্রয়াত হন সুদেবী। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন উমা। হাই-প্রেসার, সুগারের উপসর্গে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে মন খারাপ থেকে মুক্তির সন্ধান দেন এক চিকিৎসক। উমা বলেন, ‘‘মানুষের সঙ্গে মেলামেশার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। তখনই টোটো চালানোর ভাবনাটা মাথায় আসে।’’
উমার এমন ভাবনায় ঘনিষ্ঠরা অবাক হলেও, ছেলে-বৌমারা বাধা দেননি। ২০১৬ সালে একটি টোটো কিনে যাত্রী পরিবহণ শুরু করেন। উমা জানান, অবসরকালীন যে পেনসন তিনি পান, তাতে তাঁর অভাব নেই। তাই টোটো চালিয়ে লাভের কথা ভাবেন না তিনি। উমার নাতি দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া শঙ্করনারায়ণ গুপ্তর কথায়, ‘‘শুরুতে অনেকে হাসাহাতি করত। তবে আমার পরোপকারী দাদুকে এখন এলাকার সকলে খুব ভালবাসেন।’’ শহরের এক অসুস্থ বৃদ্ধকে রাত দশটায় হাসপাতালে ডায়ালিসিস করতে নিয়ে যাওয়া, ফের রাত দু’টোয় ফিরিয়ে নিয়ে আসার মতো পরিষেবাও হাসিমুখে দেন উমা।
উমার টোটোর যাত্রী প্রবীণা মঞ্জু দাস বলছেন, ‘‘রাত-বিরেতে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হলে উমাবাবুকে ফোন করলেই, উনি টোটো নিয়ে হাজির হয়ে যান।’’ সম্প্রতি গ্রাম থেকে আসা এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা উমার টোটোয় চড়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালের আউটডোরে। খুচরো না থাকায় ভাড়া মেটাতে পারছিলেন না ওই তরুণী। উমা বলেন, ‘‘অন্তঃসত্ত্বা ওই তরুণী যাত্রীকে দেখে মায়া হল। তাই ভাড়া নিইনি।’’ উমা জানাচ্ছেন, সারাদিন যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে মন ভাল হয়ে যায় তাঁর। সাধারণত, রোজ সকাল সাড়ে ছ’টায় টোটো নিয়ে বেরোন উমা। দুপুর ১২টায় বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়েন বিকেল সাড়ে তিনটায়। ফেরেন সন্ধ্যা সাতটায়। ঝাড়গ্রাম টোটো ইউনিয়নের নেতা কার্তিক আঢ্য বলছেন, ‘‘স্ত্রীর মৃত্যুর পরে নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি পেতে টোটো চালান উমাবাবু। আমাদের পেশাকে উনি সম্মানিত করেছেন।’’