প্রতিশ্রুতির ঘোলা জলই ভরসা রেলশহরে

সাতসকালেই বালতি হাতে কুয়োপাড়ে লম্বা লাইন। এলাকার একমাত্র কুয়ো যে এটাই। খড়্গপুর শহরের দক্ষিণ দিকে টুরিপাড়া তেলুগুবস্তিতে এই দৃশ্য গরমকাল জুড়েই চোখে পড়ে। রেল এলাকার অন্তর্গত এই ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর ছিলেন কংগ্রেসের তপনকুমার বসু ওয়ার্ডের। পুরসভাতেও ক্ষমতাসীন ছিল কংগ্রেস। তারপরেও এলাকায় টাইমকল নেই?

Advertisement

দেবমাল্য বাগচি

খড়্গপুর শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:২১
Share:

পানীয় জলের জন্য তেলুগু বস্তির বাসিন্দাদের ভরসা এখনও কুয়োই।

সাতসকালেই বালতি হাতে কুয়োপাড়ে লম্বা লাইন। এলাকার একমাত্র কুয়ো যে এটাই। খড়্গপুর শহরের দক্ষিণ দিকে টুরিপাড়া তেলুগুবস্তিতে এই দৃশ্য গরমকাল জুড়েই চোখে পড়ে। রেল এলাকার অন্তর্গত এই ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর ছিলেন কংগ্রেসের তপনকুমার বসু ওয়ার্ডের। পুরসভাতেও ক্ষমতাসীন ছিল কংগ্রেস। তারপরেও এলাকায় টাইমকল নেই?

Advertisement

জবাব চাইতেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ওয়ার্ডবাসী। স্থানীয় পিঙ্কি নায়েক, এম রবি কুমার বললেন, “এলাকায় ঘুরে দেখুন একটিও টাইমকল নেই। আগে যে টিউবওয়েলগুলি ছিল সেগুলি ভেঙে গিয়েছে। আর একটি কুয়ো ব্যবহারের অযোগ্য। একমাত্র এই কুয়োই আমাদের তিনশো পরিবারের ভরসা। গত ভোটের আগে সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কাউন্সিলরও সেই ২০১০ সালে ভোট চাইতে শেষবার এলাকায় এসেছিলেন।’’

রেলশহরের উত্তরদিকে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের নালিপাড়ায় অবশ্য টাইমকল রয়েছে। তবে এখানেও জলসঙ্কটের ছবিটা একই। বাসিন্দাদের অভিযোগ, তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর রিনা শেঠের এই ওয়ার্ডে জল পড়ে সুতোর মতো। আবার কখনও জল পড়েই না। পাম্প দিয়ে জলচুরি অভিযোগও দীর্ঘদিনের। ২০১০ সাল থেকে সাড়ে তিনবছর খড়্গপুর পুরসভা পরিচালনা করেছে তৃণমূল। তারপরেও জলসঙ্কট কাটেনি। স্থানীয় প্রৌঢ়া সুনাইনা শর্মা বলেন, “ছিঁটেফোটা জল পাই। কাউন্সিলরকে বলেও লাভ হয়নি। এখন ভোটের মুখে নতুন ডিপ-টিউবওয়েল হচ্ছে। কিন্তু চার ইঞ্চির পাইপের ডিপ-টিউবওয়েল থেকে জল আসবে কি না কাউন্সিলরই বলতে পারবেন।’’

Advertisement

শুধু এই দু’টি ওয়ার্ড নয়, খড়্গপুর পুর এলাকার সর্বত্র কম-বেশি জলসঙ্কটে জেরবার নাগরিকেরা। অবশ্য গত পুরসভা নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই এই সমস্যা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১০ সালের শেষ পুরভোটে ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতে জিতে পুরবোর্ড গড়ে তৃণমূল। তবে সাড়ে তিন বছর পরে অনাস্থা ভোটাভুটিতে জিতে ক্ষমতা দখল করে কংগ্রেস। পুরবাসীদের বক্তব্য, পাঁচ বছর আগে প্রতিশ্রুতি দিলেও তৃণমূল বা কংগ্রেস কেউই জলের সমস্যা মেটাতে সচেষ্ট হয়নি। দুই পুরবোর্ডেরই দাবি, জলের সরবরাহের প্রতিশ্রুতি রাখতে যথেষ্ট কাজ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছোট ডিপ-টিউবওয়েল ও কংসাবতীর ধারে ৭টি বড় ডিপ-টিউবওয়েল গড়ে সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া তৃণমূল জমানায় শুরু হওয়া দ্বিতীয় জলপ্রকল্পের শেষ পর্যায়ের কাজ জোরকদমে চলছে বলেও দাবি কংগ্রেসের।

পর্যাপ্ত সংখ্যায় ট্যাপ কল নেই। জলের জন্য প্রতীক্ষা অম্বেডকরনগরে।

রেল এলাকার ৮টি ওয়ার্ডের বস্তি এলাকায় জল সরবরাহে কংগ্রেস পুরবোর্ড উদ্যোগী হলেও রেলের বাধার অভিযোগ উঠেছে। তবে রেলের এলাকা বাদ দিলেও বাকি ২৭টি ওয়ার্ডেও জলাভাবেরই ছবি সামনে এসেছে। বিশেষ করে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ১২, ১৭, ২৪, ২৯, ৩২, ৩৩, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে পানীয় জলের সমস্যায় জেরবার বাসিন্দারা। রয়েছে ঘোলা জল সরবরাহের অভিযোগও। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের রবীন্দ্রপল্লির সঙ্গীতা যাদব বলেন, “১০ বছর হল এই ওয়ার্ডে বাড়ি করেছি। বাড়ি তৈরির সময় থেকেই জলের সমস্যা দেখছি। দিনে দু’বার জল এলেও পর্যাপ্ত নয়। অধিকাংশ সময় ব্যবহারের অযোগ্য ঘোলা জল পড়ছে।’’ পর্যাপ্ত জল মিলছে না ১ নম্বর ওয়ার্ডে ইন্দার ভাটাপুকুর ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্যাসাগরপুরে। তবে বিদ্যাসাগরপুরে দিন পনেরো আগে একটি ডিপ-টিউবওয়েলের মাধ্যমে জলের সমস্যা মেটানো হয়েছে। স্থানীয় এক বাসিন্দার কটাক্ষ, “দিন পনেরো আগেও জল আসছিল না। কিন্তু ভোট চাইতে এসে তৃণমুলের বিদায়ী কাউন্সিলের স্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হবে জেনে এখন ডিপ-টিউবওয়েল খুঁড়ে জল দিচ্ছে।’’

পুরসভা সূত্রে খবর, ১৯৯৯ সালের আগে শহরের কয়েকটি ওয়ার্ডে ডিপ-টিউবওয়েল খনন করে জল সরবারহ করা হত। তবে নয়ের দশক থেকে সমস্যা চরমে ওঠে। তখন দিনে প্রায় ২ মেগা গ্যালন জলের চাহিদা ছিল। সেই চাহিদা পূরণে কাঁসাই থেকে প্রথম জলপ্রকল্প গড়ে জল সরবরাহ করা হয়েছিল। ১০ বছরে বসতি বেড়েছে। জলের চাহিদা পৌঁছেছে দিনে সাড়ে ৩ মেগা গ্যালনে। ২০০৯ সালে কংগ্রেস পুরবোর্ড দ্বিতীয় জলপ্রকল্প গড়তে রাজ্যের মাধ্যমে কেন্দ্রের কাছে ৮১ কোটি টাকা দাবি করে। ২০১০ সালে প্রায় ৮৬ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে কেন্দ্রীয় সরকার। সে বছরই কংগ্রেসকে হঠিয়ে পুরবোর্ডে ক্ষমতায় এসে তৃণমূল বরাদ্দ টাকায় জলপ্রকল্পের কাজ শুরু করে। এখনও পর্যন্ত তিনটি পর্যায়ে পুরসভা ৩২ কোটি টাকা পেয়েছে। তৃণমূল বোর্ডের সাড়ে তিন বছরে ৭ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। আর বিদায়ী কংগ্রেস বোর্ডের হাতে এখনও ১৬ কোটি টাকা আছে। কংগ্রেস পুরবোর্ডের দাবি, জলের উৎস না খুঁজেই তৃণমূল বোর্ড পাইপ বসানোর মতো অপরিকল্পিত কাজ করেছিল। আর তৃণমূলের পাল্টা অভিযোগ, কাজ করতে না পেরে ভিত্তিহীন দাবি করছে কংগ্রেস।

শহরের মানুষ রাজনৈতিক চাপানউতোরে না গিয়ে এখন পাঁচ বছরের হিসেব চাইছেন। তাঁদের অভিযোগ, পাঁচ বছরে দুই বোর্ডের পুরপ্রধানরা কাউন্সিলরদের উপর নজরদারির চালাননি। স্বজনপোষণের জেরে কলের মুখে পাম্প বসিয়ে উঁচু এলাকার বাসিন্দারা জল টেনে নেওয়ায় নিচু এলাকার বাসিন্দারা জল পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ। এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি ২, ৭, ৮, ১২, ১৭, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। তার উপর দ্বিতীয় জলপ্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ছে। যদিও কংগ্রেস বোর্ডের বিদায়ী পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডে বলেন, “আমরা বহু এলাকায় টাইমকলে লাগানো পাম্পসেট বাজেয়াপ্ত করেছি। এখন শহরে সার্বিক জলসঙ্কট নেই। জলের যে চাহিদা ছিল তা আমাদের সময়ে ৪টি ও তৃণমূলের সময়ে ৩টি বড় ডিপ-টিউবওয়েল এবং পাড়ায় পাড়ায় ডিপ-টিউবওয়েল করে কমানো হয়েছে। এখন মাত্র আধ মেগা গ্যালন জলের অভাব রয়েছে। তাই কিছু ওয়ার্ড অপর্যাপ্ত জল পাচ্ছে এটা ঠিক।’’ বিদায়ী পুরপ্রধানের আরও দাবি, তৃণমূলের অপরিকল্পিত কাজে গতি হারিয়ে ফেলা জলপ্রকল্পের কাজ যেভাবে দেড় বছরে গতি এসেছে তাতে চলতি বছরেই কাজ শেষ হবে। আর তাতে অতিরিক্ত যে ৪ মেগা গ্যালন জল পাওয়া যাবে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি।

তাঁদের সময়ে জলসঙ্কটের প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে পুরসভা এগোলেও এখন জলের সমস্যা নতুন করে দেখা দিয়েছে বলে দাবি তৃণমূলের। পুরবোর্ড তাঁদের হাতে এলে তাই জলসঙ্কটে অগ্রধিকারের তালিকায় রাখার দাবি করে তৃণমূলের প্রাক্তন পুরপ্রধান জহরলাল পাল বলেন, “আমার সাড়ে তিন বছরে আমরা পুর-এলাকার সর্বত্র ছোট ছোট ডিপ-টিউবওয়েল করে জলসঙ্কট মিটিয়েছিলাম। পরে সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। জলপ্রকল্পের কাজও গতি পায়নি। ফলে জলসঙ্কট ফিরে এসেছে।’’

ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement