বন্ধ রামস্বরূপ লৌহ উদ্যোগ কারখানা। —নিজস্ব চিত্র।
শিল্পতালুকে শিল্প নেই। কারখানা না হওয়ায় ফাঁকা পড়ে কয়েকশো একর জমি। শিল্প কোথায়, খড়্গপুর গ্রামীণে ভোটের প্রচারে বিরোধীদের তাই একটাই প্রশ্ন।
পরিবর্তনের ঝড়েও গত বিধানসভা ভোটে এই আসনে জয় পেয়েছিল বামেরা। প্রায় ৪৬.৭৮ শতাংশ ভোটও ছিল বামেদের দখলে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বাম ভোটব্যাঙ্কে ধস নামে। বামেদের ভোট প্রায় ১২ শতাংশ কমে হয় ৩৪.৬৫। রাজ্যের হতাশাজনক শিল্পচিত্রকে প্রচারে তুলে ধরেই হারানো ভোট ফিরে পেতে চাইছে বামেরা।
খড়্গপুর গ্রামীণ কেন্দ্রের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শিল্প এলাকা। এখানেই রয়েছে বিদ্যাসাগর ও নিমপুরা শিল্পতালুক। বাম আমলে খড়্গপুরের রূপনারায়ণপুরে শিল্পতালুকের জন্য প্রায় ১২৪৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কয়েকটি কারখানাও তৈরি হয়। যদিও এখনও ৯৪২ একর জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। শিল্পতালুকের জন্য জমি দিয়েছেন এমন অনেকে কাজ পাননি বলে বিরোধীদের অভিযোগ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মেদিনীপুরের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পতালুকের ১২ একর জমিতে স্টেডিয়াম গড়ার কথা ঘোষণা করেন। তাতে স্থানীয়দের একাংশের ক্ষোভ আরও বাড়ে। স্টেডিয়াম নয়, শিল্পতালুকের জমিতে কারখানার দাবিতে বিক্ষোভও দেখায় স্থানীয়দের কয়েকজন।
শিল্পতালুকের এক জমিদাতা উত্তম ঘোষ বলেন, ‘‘বাম আমলে চাকরির আশায় জমি দিয়েছিলাম। আমি অনেককে জমি দিতে রাজি করিয়েছিলাম। এখনও অধিকাংশ জমিদাতার চাকরি হয়নি। এ জন্য বামেরা দায়ী। তবে বিগত পাঁচ বছর তৃণমূল সরকারের আমলে একটাও শিল্প আসেনি। উল্টে শিল্পের জমিতে স্টেডিয়াম হচ্ছে। এটা আমরা মেনে নেব না।’’
খড়্গপুরের নিমপুরা শিল্পতালুকে রামস্বরূপ লৌহ উদ্যোগ, কালামাটি স্টিল-সহ বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ। ৫১ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না রামস্বরূপ লৌহ উদ্যোগের ১৭৭৩ জন শ্রমিক-কর্মচারী। রামস্বরূপ লৌহ উদ্যোগ কারখানার এক শ্রমিক নেপাল শীট বলেন, “২০১০ সালে কারখানা বন্ধ হলেও বেতন পেয়েছি। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত বেতন বন্ধই রয়েছে। রাজ্য সরকার এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করেনি। এ বার তৃণমূল সমর্থক অনেক শ্রমিকও ওদের ভোট দেবে না।’’ কর্মহীন আরও বহু শ্রমিক। কাজ হারিয়ে অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন অনেকে।
ভোটের আগে নারদ কাণ্ড প্রকাশ্যে আসায় অস্বস্তিতে শাসকদল। সতকুই এলাকার বাসিন্দা কানু ঘোষ, বড়কোলা এলাকার বাসিন্দা রামপদ জানা বলেন, “বিদায়ী সরকারের বহু সাংসদ-মন্ত্রীকে দেখে আমাদের মতো বহু গরিব মানুষ টাকা দ্বিগুণ করার আশায় চিটফাণ্ডে সঞ্চয় করেছিলেন। নারদ কাণ্ড সামনে আসার পর সকলের কাছে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এ বার ভোটে এ সবের প্রভাব পড়বে।’’
খড়্গপুর গ্রামীণ বিধানসভার ৭টি অঞ্চল খড়্গপুর-১ ব্লকের অধীনে। বাকি ৫টি অঞ্চল মেদিনীপুর সদর ব্লকের অন্তর্গত। গত বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী নাজমুল হক মোট ৭০,১৭৮টি ভোট পেয়েছিলেন। তিন হাজারের কিছু বেশি ভোটে পিছিয়ে ছিলেন তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী বিলকিস খান। গত পঞ্চায়েত ভোটেও খড়্গপুর-১ ব্লকের গোপালী, অর্জুনী, বড়কোলার মতো অঞ্চলে জয়ী হয় বামেরা। যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে বামেরা। লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে ৯.৫৮ শতাংশ বিজেপির দখলে ছিল। এ বার অবশ্য বিদায়ী বিধায়ক নাজমুল হক প্রার্থী হননি। নতুন মুখ শাহজাহান আলিকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে বামেরা। দলীয় সূত্রে খবর, মেদিনীপুর সদর ব্লক নিয়ে চিন্তায় বাম নেতৃত্ব। তবে বিজেপির ভোটের একটা অংশ তাঁদের দিকে আসবে বলেও আশাবাদী বামেরা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, গতবার লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৩.০৯ শতাংশ ভোট। এ বার বাম-কংগ্রেস জোট হওয়ায় কংগ্রেসের ভোটের একটা বড় অংশ বামেদের দিকে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে হারানো ভোট কতটা পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে, তার উপরেই বামেদের জয় অনেকটা নির্ভর করবে। বাম প্রার্থী শাহজাহান আলি বলেন, “অবাধ ভোট হলে জয় নিশ্চিত। তবে মেদিনীপুর নিয়ে চিন্তা রয়েছে।’’ কোন অঙ্কে জয়ের স্বপ্ন দেখছেন? শাহজাহান আলি বলছেন, “খড়্গপুর গ্রামীণে একাধিক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে রয়েছে। বহু মানুষ বেকার। সাধারণ মানুষ তৃণমূলকে আর চায় না।’’
দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়কে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। তিনি তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-রও জেলা সভাপতি। দীনেনবাবুর বিরুদ্ধে গোঁজ প্রার্থী হয়েছেন খড়্গপুর-১ ব্লকের আইএনটিটিইউসি নেতা শেখ আনোয়ার। বাড়ি বাড়ি প্রচারও করছেন তিনি। শেখ আনোয়ারের দাবি, “সিপিএমের সঙ্গেই লড়াই হবে। আমিই জয়ী হব। দীনেন রায় তৃতীয় স্থান পাবেন।” যদিও জয় নিয়ে প্রত্যয়ী দীনেনবাবু বলছেন, ‘‘জেলার ১৯টি কেন্দ্রেই আমরা জয়ী হব।’’
খড়্গপুর গ্রামীণে তুলনায় পিছিয়ে গেরুয়া শিবির। নড়বড়ে সংগঠন নিয়ে চিন্তায় বিজেপি নেতৃত্ব। এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী গৌতম ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘সাংগঠনিক দুর্বলতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে। খড়্গপুরে নরেন্দ্র মোদী সভা করার পর আমাদের জয় আরও নিশ্চিত হয়েছে।’’