দুয়ারে সরকার শিবিরে জাতিগত শংসাপত্র সংগ্রহের লাইন। —নিজস্ব চিত্র।
ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র নিয়ে মাঝেমধ্যে বিতর্ক তৈরি হয় রাজ্যে। বাম থেকে হাল। সব আমলেই অভিযোগ ওঠে কমবেশি। এখন যেমন বিতর্ক চলছে মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে ভুয়ো শংসাপত্র দাখিলকে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়েছিল হাই কোর্টে। মামলা হাই কোর্ট থেকে আপাতত সরেছে সুপ্রিম কোর্টে। এই আবহে এক ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ। ওই ছাত্রী ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র দিয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে না হলেও ঝাড়গ্রামেও ভুয়ো শংসাপত্রের অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি। ভুয়ো শংসাপত্রের জন্য এক মহিলা প্রধানপদ হারিয়েছিলেন। তবে প্রশাসনের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদন করে সেই পদ ফিরে পেয়েছেন তিনি। ফিরে পেয়েছেন তফসিলি জাতির মর্যাদাও। তবে যে কোনও অভিযোগের মতো ভুয়ো শংসাপত্রকে ঘিরেজুড়ছে রাজনীতি।
পরিষেবা দেওয়ার জন্য জঙ্গলমহলে ঢালাও জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে। ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল ঝাড়গ্রাম পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার জন জাতিগত শংসাপত্র পেয়েছেন। জেলার মোট জনসংখ্যার ২৯.৯৮ শতাংশ জনজাতি (এসটি)। ২০.৭ শতাংশ তফসিলি জাতিভুক্ত (এসসি)। এই জেলাতেও প্রায়ই ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র পাওয়ার অভিযোগ উঠছে। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসনিক তদন্তে জাতিগত শংসাপত্র বাতিলও হচ্ছে। সম্প্রতি জামবনি ব্লকের একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মহিলা প্রধানের তফসিলি জাতির (এসসি) শংসাপত্র বাতিল হয়েছে। প্রধান পদটি তফসিলি জাতির (এসসি) জন্য সংরক্ষিত ছিল। তৃণমূলের টিকিটে জিতে বিরোধীপক্ষ কুড়মিদের সমর্থনে প্রধান হওয়ার পরই ওই মহিলার জাতিগত শংসাপত্র নিয়ে অভিযোগ দায়ের হয়। তদন্তে জানা যায়, ওই প্রধানের জাতিগত পরিচয় ভুয়ো। এরপরই প্রধান পদ থেকে ওই মহিলাকে অপসারণ করা হয়। এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে প্রধান পদ ফিরে পান ওই মহিলা।
জাতিগত শংসাপত্র প্রাপ্তি ও বাতিলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগও উঠেছে। বাম আমলেও জঙ্গলমহলে অভিযোগের ভিত্তিতে জাতিগত শংসাপত্র বাতিল হয়েছে। আগে শংসাপত্র পাওয়ার বিষয়টি অনেক সহজ ছিল। জমির সাবেক নথিতে পূর্বপুরুষের জাতির উল্লেখ থাকত। মূলত জমির নথির ভিত্তিতে জাতিগত শংসাপত্র সহজে পাওয়া যেত। অভিযোগ, বাম আমলে যথাযথ নথি না থাকলেও পঞ্চায়েত প্রধানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং এলাকায় গিয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখে জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের জমানায় ছবিটা বিশেষ বদলায়নি বলেই দাবি। কারণ, বিগত একাধিক নির্বাচনের আগে সংরক্ষিত আসনে দলীয় প্রার্থীর তড়িঘড়ি জাতিগত শংসাপত্র তৈরির নজিরও রয়েছে।
গত বছর থেকে এ রাজ্যে জাতিগত শংসাপত্রের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া অনলাইনে হচ্ছে। তবে আবেদনকারীর নথিপত্র বিডিও অথবা এসডিও-র দফতরে জমা দেওয়া হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আবেদনকারীর উপযুক্ত নথিপত্র না থাকলে স্থানীয়স্তরের তথ্যের ভিত্তিতে শংসাপত্র দেওয়া হয়। অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘প্রত্যন্ত এলাকায় সচেতনতার অভাবে কেউ কেউ জাতিগত শংসাপত্র করাননি। পূর্বপুরুষের মৃত্যুও হয়েছে। এমন নজিরও রয়েছে। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম যাতে বঞ্চিত না হন, সে জন্য আমাদের দফতরের তরফে ফিল্ড এনকোয়ারি করে সেই রিপোর্ট বিডিও অথবা এসডিও দফতরে জমা দেওয়া হয়।’’ ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক শুভ্রজিৎ গুপ্ত বলছেন, ‘‘জাতিগত শংসাপত্র নিয়ে অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শো-কজ করা হয়। তারপর শুনানির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তনেওয়া হয়।’’
ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র নিয়ে সরব বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। প্রশাসনিক মহলে এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার স্মারকলিপিও দিয়েছে আদিবাসী সংগঠনগুলি। ভারত জাকাত মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মুর্মু বলছেন, ‘‘যাঁরা কোনও ভাবেই আদিবাসী নন, এমন সব লোকজনদের জাতিগত শংসাপত্র পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক মহলে বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন একক ও যৌথভাবে অভিযোগ জানিয়েছে।’’ চাকরির সংরক্ষণ, নির্বাচনের সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী হওয়া ও সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জাতিগত শংসাপত্রের গুরুত্ব রয়েছে।
বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা সহ-সভাপতি দেবাশিস কুণ্ডু বলছেন, ‘‘বাম আমলে মানুষজনকে ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূলের জমানায় রাজনৈতিক স্বার্থে ঢালাও ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে।’’ সিপিএমের ঝাড়গ্রাম জেলা সম্পাদক প্রদীপকুমার সরকার বলছেন, ‘‘বাম আমলে কখনই ঢালাও জাতিগত শংসাপত্র বিলি করা হয়নি। ওই আমলে যাচাই করে প্রকৃতদেরই জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল। এখন সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী করার জন্য কিংবা সরকারি পরিষেবার বিশেষ শ্রেণির উপভোক্তা তালিকায় নাম তোলাতে ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি প্রসূন ষড়ঙ্গী বলছেন, ‘‘বাম আমলে ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল। কেউ ভুয়ো তথ্য দিয়ে জাতিগত শংসাপত্র পেয়ে থাকলে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন।’’