মেদিনীপুর শহরে মাথা তুলছে পর পর বহুতল। —নিজস্ব চিত্র।
মেদিনীপুর শহরের মিঁয়াবাজার এলাকাটি ঘিঞ্জি। এখানেও গড়ে উঠছে বহুতল। ইতিমধ্যে সাততলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। আর ক’তলা উঠবে? এক পুর- আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘ওখানে একটা বহুতল হচ্ছে বলে শুনেছি! ক’তলার হবে, খোঁজ নিয়ে বলতে পারব।’’
কলকাতার গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। জখম একাধিক। আশঙ্কা, এমন দুর্ঘটনা মেদিনীপুরেও ঘটতে পারে। কারণ, শহরে বেআইনি বহুতল নির্মাণ যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। পুর-কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, যারা বেআইনি কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে।
কিছু দিন আগেই মেদিনীপুরে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মেদিনীপুরের মতো তুলনায় ‘ছোট’ শহরে এত উঁচু উঁচু বহুতল দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। এক বৈঠকে পুরপ্রধান সৌমেন খানকে কার্যত বকাঝকাও করেছিলেন তিনি। বৈঠকে তাঁর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন ছিল, ‘মেদিনীপুরে এত উঁচু উঁচু বাড়ি হচ্ছে কী করে? ১০-১২ তলা বাড়ি! কে পারমিশন দিচ্ছে? কী ভাবে দিচ্ছে?’ শহরে বেআইনি নির্মাণ বরদাস্ত করা যাবে না, পুরপ্রধানকে স্পষ্ট বুঝিয়েছিলেন তিনি। পুরপ্রধানের সাফাই ছিল, ওই সব বাড়ি তৈরির অনুমতি বিগত পুরবোর্ড দিয়েছে। শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি কোনও কথা (অজুহাত) শুনতে চাই না।’ এত উঁচু বাড়িতে কোনও অঘটন ঘটলে তার দায় কে নেবে, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন মমতা।
আগেও জেলা সফরে এসে বহুতল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর দিন কয়েক কাজ বন্ধ থেকেছে। পরে বেআইনি নির্মাণ ফের রমরমিয়ে চলেছে।বস্তুত, শহরে এখন বেপরোয়াভাবে বেআইনি বহুতল নির্মাণ চলছে। বেআইনি নির্মাণের সংখ্যা মাত্রাছাড়াভাবে বাড়ার সঙ্গে তৈরি হয়েছে অসাধু প্রোমোটার-চক্র। যাদের ‘দাপটে’ পিছিয়ে পড়ছেন আইন মেনে চলা প্রোমোটাররা। পুরসভা থেকে অনুমোদন নেওয়া হচ্ছে চার-পাঁচতলা বাড়ি তৈরিরই, কিন্তু পরে বিপজ্জনকভাবে দশ-বারোতলা বাড়ি হচ্ছে, এমনকি তারও বেশি! চারপাশে যথেষ্ট জমি না ছেড়ে, পুর-আইনকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়েই মাথা তুলছে উঁচু বাড়ি।
শহরবাসীর একাংশের মতে, বিপজ্জনক বহুতল তৈরি হওয়া ঠেকাতে পুরসভার উচিত কড়া পদক্ষেপ করা। পুরসভার এক সূত্রে খবর, ২০১৮ থেকে ২০২১, চার বছরেই অন্তত ১৫টি বহুতল হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি দশতলার, ৫টি ন’তলার, ৭টি আটতলার। বেশিরভাগই বেআইনি। বহুতলগুলি তৈরি হয়েছে বার্জটাউন, রবীন্দ্রনগর, স্টেশনরোড, ক্ষুদিরামনগর, বিধাননগর, কুইকোটা, মির্জাবাজার, অরবিন্দনগর প্রভৃতি এলাকায়।
বর্তমান মেদিনীপুরের পুরবোর্ড তৃণমূলের দখলে। বিগত পুরবোর্ডও তাদেরই ছিল।জেলা বিজেপির মুখপাত্র অরূপ দাসের নালিশ, ‘‘তৃণমূলের লোকেদের মদতেই শহরে বেআইনি নির্মাণের এমন বাড়বাড়ন্ত। পুর-প্রশাসনের নজরদারিই নেই।’’ সিপিএমের এরিয়া কমিটির সম্পাদক কুন্দন গোপের দাবি, ‘‘মেদিনীপুরে ৯০ শতাংশ বহুতলই আইন মেনে হয়নি। কোথাও পার্কিং প্লেস নেই। অথচ, শপিং মল হচ্ছে। পরিকল্পনাহীন এই কাজকর্মের পিছনে প্রোমোটারের সঙ্গে পুর-কর্তৃপক্ষের দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার নিশ্চয়ই রয়েছে।’’
মেদিনীপুরের পুরপ্রধান সৌমেন খানের দাবি, ‘‘এখন নতুন করে শহরে বহুতল তৈরির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।’’ এক পুর-আধিকারিক জুড়ছেন, ‘‘কেউ যদি চার-পাঁচতলা বাড়ির অনুমোদন নিয়ে, আট-দশতলা বাড়ি তৈরি করেন, সে ক্ষেত্রে পুরপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট বহুতলকে বেআইনি বলে ঘোষণা করবে।’’ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রোমোটার অবশ্য শোনালেন, ‘‘অনিয়ম হয়ে থাকলে জরিমানা দিয়ে সব লিগ্যালাইজ করে নিই। কোথায় কী দিয়ে এ সব করতে হয়, জানা রয়েছে।’’