মস্তক মুণ্ডন করে ফিরছেন ছত্রধর
টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির দোতলা বাড়িটার উঠোনে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। একপাশে তৈরি করা হয়েছে বড় বড় তিনটি মাটির উনুন। আত্মীয়-কুটুম্বরা সকলেই একে একে এসে পৌঁছেছেন। অপেক্ষা কখন তিনি আসবেন? অবশেষে এলেন।
সোমবার সকালে লালগড়ের আমলিয়া গ্রামের মেঠো রাস্তায় পুলিশের গাড়ির ধুলো উড়িয়ে এলেন জনগণের কমিটির জেলবন্দি নেতা ছত্রধর মাহাতো।
দিন দশেক আগে প্যারোলে কয়েক ঘন্টার জন্য ছাড়া পেয়ে এসেছিলেন বাবা আশুতোষ মাহাতোর শেষকৃত্যে যোগ দিতে। তারপর আবার আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। পিতৃশ্রাদ্ধে যোগ দেওয়ার আবেদনও অবশ্য মঞ্জুর হয়েছে। তাই আরও দু’দিনের প্যারোলে ফিরলেন গ্রামে।
প্রথমে নির্দেশ ছিল দু’দিনই কাজ শেষ হওয়ার পরে তাঁকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি দু’রাত কাটালেন মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলেই। ছত্রধরের আইনজীবী কৌশিক সিংহ বলেন, “আলিপুর থেকে লালগড়, পরপর দু’দিন এতটা যাতায়াতের ধকল ছত্রধরের পক্ষে কঠিন হত। তাই জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কারা দফতরের আইজি-র কাছে আবেদন করা হয় যাতে এই দু’দিন তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। তার ভিত্তিতে রবিবার দুপুরেই তাঁকে আলিপুর থেকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসা হয়।”
সোমবার সকালে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় ছত্রধরকে আমলিয়া গ্রামে নিয়ে আসা হয়। ঠিক ছিল আদিবাসী কুড়মি সমাজের নিয়ম মেনেই তিনি বাবার পারলৌকিক কাজ করবেন। সেই মতো সকাল পৌনে দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে সোজা উঠে যান দোতলায়। সামান্য চা পান করেন, খোঁজ খবর নেন দুই ছেলের পড়াশোনার। ছোটভাই অনিল মাহাতোর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা করেন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নিয়ে। বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও স্বভাবসিদ্ধ পুরনো মেজাজেই দেখা যায় তাঁকে।
ছত্রধরের স্ত্রী নিয়তি মাহাতো জানলেন, চাষের ধান বিক্রি করে আর আত্মীয়স্বজনদের সাহায্যেই শ্বশুর মশাইয়ের পারলৌকিক কাজকর্ম হচ্ছে। আদিবাসী কুড়মি সমাজের নিয়ম অনুযায়ী, ছত্রধরের ভাগ্নে দিলীপ মাহাতো পারলৌকিক ক্রিয়ায় পৌরোহিত্য করেন। দুপুর ২টো নাগাদ বাড়ির পিছনের পুকুরে ‘ঘাট-কামান’ (ক্ষৌরকর্ম)-এর অনুষ্ঠান শেষে মা, স্ত্রী, ছেলে ও পরিজনদের সঙ্গে বাবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন ছত্রধর। বিকেল ৪টে নাগাদ ছত্রধর ও তাঁর ভাই এবং জ্ঞাতি ভাইয়েরা মুণ্ডিত মস্তকে স্নান সেরে নতুন ধুতি পরে কুড়মি দেব-দেবীদের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে বাড়ি ফেরেন।
বিকেলে সুজি আর ছোলা সেদ্ধ খেয়ে একপ্রস্থ আড্ডা দিয়ে নেন পরিবারের সকলের সঙ্গে। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ৬টা ছঁুইছঁুই। কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিক একবার বলেন, “কাজ তো শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার চলুন।” দেরি করেননি ছত্রধর। পোশাক বদলে হালকা নস্যি রঙের ফতুয়া আর পাজামা পরে তৈরি। পিসি অশীতিপর পানমণিদেবীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে শুধু বলেন, “ছ’বছর পরে পরিবারের সঙ্গে এতক্ষণ কাটানোর সুযোগ পেলাম। পরিজনদের দেখে জেলে থাকার কষ্ট ভুলে গিয়েছি।” এরপরই তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। মঙ্গলবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দেবেন ছত্রধর।