পোড়ানো হয় এই রাবণকেই। — নিজস্ব চিত্র।
দশমীর সকালে আকাশে ধূসর মেঘের আনাগোনা দেখে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল ‘রাবণ শিল্পী’ লক্ষ্মীকান্ত দাসের। বছর তিরিশের লক্ষ্মীকান্তবাবু লালগড় টেলিফোন কেন্দ্রের অস্থায়ী কর্মী। তবে রাবণ গড়তে তিনি সিদ্ধহস্ত।
পুজোর সময় বৃষ্টি হয়েছিল। নবমীর রাতেও বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে দশমীর সকালে মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি ভাবিয়ে তুলেছিল রাবণ দহন অনুষ্ঠানের আয়োজকদের। অন্যান্য বছর বিকেল তিনটের মধ্যে রাবণের কাঠামো দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। এ বার আকাশ বুঝে রাবণকে খাড়া করতেই সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। সন্ধ্যে ঘনাতেই লালগড় ফুটবল মাঠে তখন গিজগিজ করছে অগুন্তি মানুষের মাথা। সকলেই দশাননকে দেখতে ব্যস্ত। রাত আটটা নাগাদ শুক্লপক্ষের রাতের আকাশ আরও আলোময় হয়ে উঠল আতশবাজির রোশনাইয়ে। রাত দশটা নাগাদ শুরু হয় রাবণ পোড়া। জ্বলতে থাকা ফুট তিরিশের রাবণকে ধরাশায়ী হতে দেখে হর্ষধ্বনি করে উঠল জনতা।
লালগড়ের ঐতিহ্য-প্রাচীন রাবণ-দহনের পরম্পরার ইতিহাস বহু পুরনো। এক সময় লালগড়ের রাজাদের উদ্যোগে অশুভ-শক্তির বিনাশের প্রতীকী এই অনুষ্ঠান হত। পরে গত ছয় দশক ধরে ‘লালগড় যুব সংস্থা’ পরিচালিত লালগড় সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির উদ্যোগে ‘রাবণ দহন’-এর অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হচ্ছে। আগে লালগড়ের কাঠচাঁড়া ডাঙা মাঠে রাবণ পোড়ানো হতো। মাওবাদী সন্ত্রাসপর্বে ২০০৯ থেকে ২০১১ তিন বছর রাবণ পোড়ানোর অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। ইতিমধ্যে কাঠচাঁড়া ডাঙায় সিআরপি ক্যাম্প হয়ে গিয়েছে। ফলে ২০১২ সাল থেকে রাবণ দহনের অনুষ্ঠানটি হচ্ছে লালগড়ের ফুটবল মাঠে।
শিল্পী লক্ষ্মীকান্তবাবু জানালেন, প্রথমে মাটি দিয়ে রাবণের এক একটা মুণ্ডু তৈরি করেন। তার উপর কাগজের পর কাগজ সাঁটিয়ে অবয়ব ছেঁচে নেন। বাঁশের কাঠামোর উপর রঙিন কাগজ সাঁটিয়ে তৈরি হয় ধড়। ভিতরে ঠাসা হয় আতশবাজি। বানাতে সময় লাগে প্রায় এক মাস।
এলাকায় ‘রাবণ পোড়ার মেলা’টি অন্যতম সেরা মিলনোৎসব। এ দিন মেলায় আশেপাশের গাঁ-গঞ্জ থেকে কয়েক হাজার মানুষ আসেন। এসেছিলেন বহিরাগত দর্শনার্থীরাও। এ দিন সন্ধ্যায় প্রথমে হল আতসবাজির প্রদর্শনী। তারপর রাবণের অবয়বে আগুন ধরানো হয়। রাবণ পোড়া শেষ হলে তবেই প্রতিমা নিরঞ্জন করা হল স্থানীয় হায়দার দিঘিতে।
পুজো কমিটির সম্পাদক অরূপকুমার সাহসরায় বলেন, “বৃষ্টিতে রাবণ ভিজে গেলে সমস্যা হত। আকাশ দেখে আতসবাজি ভরে রাবণকে দাঁড় করাতেই বেশ কিছুটা দেরি হয়। রাবণ দহনের সময় আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে সব মিলিয়ে প্রায় হাজার বিশেক মানুষের জমায়েত হয়েছিল।”