প্রতীকী ছবি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে জঙ্গলমহলের ‘দুষ্টু’ হাতি ধরে পাঠানো হল উত্তরবঙ্গে। হাতির এই উত্তরবঙ্গ যাত্রা নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের নেতা-জনপ্রতিনিধিরা দাবি করছেন, ‘‘এর ফলে দুষ্টু হাতিদের উপদ্রব কমবে। জঙ্গল এলাকার বাসিন্দারা স্বস্তিতে বসবাস করতে পারবেন।’’ পাশাপাশি, শাসকদলের একাংশের মত, হাতির কারণে জঙ্গল লাগোয়া এলাকাগুলিতে ফসল, সম্পত্তির ক্ষতি ও প্রাণহানি হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা এলাকাবাসীর প্রশ্নের মুখে পড়ছেন। ফলে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে হাতি সমস্যা মেটানো জরুরি। বিরোধীদের অবশ্য কটাক্ষ, এ সব চমক। আখেরে লাভ কিছুই হবে না। এ ভাবে সমস্যার সমাধানও সম্ভব নয়। কেবল অর্থের অপচয় হবে।
সেপ্টেম্বরের গোড়ায় নবান্নে এক প্রশাসনিক বৈঠকে এ ভাবেই হাতির সমস্যা মেটাতে নয়া দাওয়াই বাতলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের অনুমতি মেলায় হাতি ধরার জন্য উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়া থেকে দুই কুনকি হাতি নিয়ে আসা হয় ঝাড়গ্রামের জঙ্গলমহল জুলজিক্যাল পার্কে। বৃহস্পতিবার দিনভর শীর্ষ বনকর্তাদের উপস্থিতিতে দুষ্টু হাতি ধরার জন্য অভিযান চলে। সকালেই একটি বছর কুড়ির ‘দুষ্টু’ পুরুষ দাঁতালকে ট্র্যাক করা হয়। এরপর হাতিটিকে লক্ষ্য করে একাধিকবার ঘুমপাড়ানি ডার্ট ছোড়া হয়। শেষে বিকেলে মেদিনীপুর রেঞ্জের অফিসার পাপন মহান্তের ছোড়া ডার্টেই কাবু হয় দাঁতাল। জঙ্গলে আচ্ছন্ন অবস্থায় স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। তবে এ দিন হাতিটিকে কাবু করতে কুনকি হাতির প্রয়োজন হয়নি।
সাধারণত, নির্দিষ্ট হাতিটি গভীর জঙ্গলে থাকলে তখন কুনকির পিঠে চেপে ডার্ট ছুড়তে সুবিধা হয়। বৃহস্পতিবার দুই কুনকিকে জঙ্গল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হলেও এ কাজে তাদের প্রয়োজন হয়নি। আচ্ছন্ন হাতিটিকে ক্রেনে বেঁধে জঙ্গল থেকে বার করতে রাত হয়ে যায়। রাত ১ টা নাগাদ হাতিটিকে আচ্ছন্ন অবস্থায় লরিতে চাপিয়ে উত্তরবঙ্গ রওনা দেন বনকর্মীরা। হাতিটির সঙ্গে রয়েছেন বন আধিকারিক ও প্রাণিচিকিৎসকরাও। ডিএফও (ঝাড়গ্রাম) শেখ ফরিদ বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে হাতিটিকে ধরে বক্সায় পাঠানো হয়েছে।’’
বন প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর মতো এর আগে এভাবে হাতির সমস্যা মেটাতে কেউই ভাবেননি। জঙ্গলমহলবাসী খুবই খুশি। আরও কয়েকটি হাতি ধরে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হবে।’’ বিরবাহা মনে করেন, হাতি নিয়ে এমন পদক্ষেপ এলাকাবাসীকে রাজ্য সরকারের প্রতি আরও আস্থাশীল করে তুলবে।
সিপিএমের ঝাড়গ্রাম জেলা সম্পাদক প্রদীপ সরকার বলছেন, ‘‘জেলায় সব মিলিয়ে ১৭০টি হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে কিছু দলছুট ও স্থানীয় হাতি রয়েছে। কয়েকটা হাতি ধরে অন্যত্র পাঠিয়ে সমস্যার সামাধান কখনই সম্ভব নয়। এটা রাজনৈতিক চমক।’’ তাঁর দাবি, বাম আমলে হাতি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ময়ূরঝর্না প্রকল্প রূপায়ণের উদ্যোগ হয়েছিল। তৃণমূলের সরকার তার বাস্তবায়ন করেনি। প্রদীপের মতে, হাতির সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিজেপির জেলা সহ-সভাপতি দেবাশিস কুণ্ডু বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটের আগে মানুষকে ভাঁওতা দিয়ে ভোট আদায়ের লক্ষ্যেই এখন মুখ্যমন্ত্রীর হাতিধরা কর্মসূচি শুরু হয়েছে।’’ দেবাশিসের কথায়, জঙ্গলমহলের জঙ্গল লুঠ হয়েছে। আবার সরকারি উন্নয়নের দোহাই দিয়েই জঙ্গল কেটে ফেলা হয়েছে। জঙ্গলে হাতির আস্তানা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। খাবারও নেই। এখন খান কতক হাতি ধরে মানুষজনকে বোকা বানানো হচ্ছে। জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মুর জবাব, ‘‘হাতির সমস্যা সমাধানে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এলাকাবাসীকে স্বস্তি দিতে আন্তরিক ভাবে পদক্ষেপ শুরু করেছে বন দফতর। তাতেই শঙ্কিত হয়ে বিরোধীরা কুৎসা করতে উঠেপড়ে লেগেছে।’’
প্রাক্তন বনকর্তা সমীর মজুমদার বলছেন, ‘‘এটা পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ। ভাল হবে কি মন্দ সেটা সময় বলবে। তবে এ ধরনের পদক্ষেপে স্থানীয় বনকর্মীদের উপর চাপ বাড়বে। কারণ, এরপর কোথাও হাতির ক্ষয়ক্ষতি বাড়লেই এলাকাবাসী হাতি ধরার দাবি করবেন।’’ সমীরও মানছেন, হাতির স্থায়ী সমস্যা মেটাতে জঙ্গলমহলের জেলাগুলিকে নিয়ে পৃথক বন বিভাগ গড়া জরুরি।