ত্রাসের তেজাব

ঘাটাল মহকুমা জুড়ে বাড়ছে তেজাব (অ্যাসিড) হানা। সাম্প্রতিকতম নিদর্শন দাসপুরে কলেজ ছাত্রীর উপর অ্যাসিড হামলা। অ্যাসিড বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কী ভাবে এত সহজে হাতে আসছে এমন উপাদান? দাসপুরের দোকান ঘুরে দেখলেন অভিজিৎ চক্রবর্তী। ‘রিঠে, কাতুড়ি, চিমটে, প্লাস পাওয়া যাবে তো?’’ হাতের কাজ সামলাতে সামলাতে দোকানদারের উত্তর, ‘মিলবে’। তারপরই বললাম, ‘‘সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিড হবে তো ?’’ উত্তর, ‘‘মিলবে’’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৬ ০৭:১৪
Share:

ছবি: কৌশিক সাঁতরা

‘রিঠে, কাতুড়ি, চিমটে, প্লাস পাওয়া যাবে তো?’’

Advertisement

হাতের কাজ সামলাতে সামলাতে দোকানদারের উত্তর, ‘মিলবে’।

তারপরই বললাম, ‘‘সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিড হবে তো ?’’

Advertisement

উত্তর, ‘‘মিলবে’’।

মিনিট চারেকের অপেক্ষা। বিনা আয়াসে হাতে এল বিয়ারের বোতল বন্দি অ্যাসিড।

ঘাটাল মহকুমা জুড়ে অ্যাসিড হানা বাড়ছে গত কয়েক বছর ধরে। গত বছরের ২৯ মে রাতে দাসপুরের নন্দনপুরে বাড়িতে ঢুকে ঘুমন্ত এক তরুণীর উপর অ্যাসিড হামলা হয়েছিল। এই মহকুমার ঘরে ঘরে সোনার কাজ হয়। অভিযুক্ত যুবক ছিল পেশায় সোনার কারিগর আর সে জানিয়েছিল দাসপুরের দোকান থেকে মিলেছিল অ্যাসিড। আর গত মঙ্গলবার তো ফের অ্যাসিড হামলার শিকার এক কলেজ ছাত্রী। সেক্ষেত্রেও অভিযুক্ত সোনার কারিগর। তাই অ্যাসিড পেতে তার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি। কিন্তু সারা দেশে তো অ্যাসিড বিক্রি নিয়ে নানা নির্দেশ রয়েছে। তা হলে কী করে এত সহজলভ্য হচ্ছে অ্যাসিড-সেটা জানতেই ক্রেতা সেজে আমার বেরিয়ে পড়া। গন্তব্য সাগরপুরের বেশ কয়েকটি দোকান। আর প্রতিটি দোকানে এক বার চাইতেই বিনা প্রশ্নে হাতে চলে এল অ্যাসিডের বোতল, যার একটা ফোঁটা শরীর পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অ্যাসিড বিক্রি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়া নিয়ম রয়েছে। যত্রতত্র অ্যাসিড ব্যবহার ও লাইসেন্স ছাড়া অ্যাসিড বিক্রি নিষিদ্ধ। সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলার রায়ে অ্যাসিড বিক্রি ও ব্যবহারের নিয়ম পরিষ্কার উল্লেখ করে দিয়েছে। এ নিয়ে আইপিসিতেও (ইন্ডিয়ান পেনাল কোড) নতুন করে ধারা সংযোজন হয়েছে। নতুন আইনে অ্যাসিড দিয়ে কাউকে আক্রমণ করলে অভিযুক্তের দশ বছরের জেল ও জরিমানার নিদানও রয়েছে। কিন্তু গোটা রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল-সহ বিভিন্ন এলাকায় খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি ও ব্যবহারে তেমল লাগাম কই?

রাজ্যে সোনার দোকান-সহ বিভিন্ন কারখানায় অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়। নিয়মানুযায়ী,অ্যাসিড বিক্রি করলে লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। বিষক্রিয়া আইনে (১৯১৯) অ্যাসিড বিক্রি, কোথা থেকে লাইসেন্স ইস্যু এবং সংশ্লিষ্ট সব ঘটনা পরিষ্কার করে বলা রয়েছে। কিন্তু জেলার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এই নিয়ম জানেন না বলেই দায় এড়িয়েছেন। অভিযোগ, কলকাতা থেকে এই সব অ্যাসিড বেশিরভাগ দোকানদাররা আনেন। এখন তো সরাসরি গাড়িতে করে দোকানে পৌঁছে দেওয়া হয়। ঘাটাল, দাসপুরেও কিছু আড়তদার রয়েছেন। গোপনে তাঁরাই স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। কারওরই লাইসেন্স নেই। সাগরপুরের এক দোকানের মালিক অমর পাল (নাম পরিবর্তিত) বলেই ফেললেন, “বহুদিন থেকে অ্যাসিড বিক্রি করছি। লাইসেন্স নেই। কলকাতা থেকে গাড়ি করে অ্যাসিড দোকানে দিয়ে যায়। পুলিশ-প্রশাসনের লোকজনও কোনও দিন আসেনি। তাই অ্যাসিড বিক্রির নিয়মও জানা নেই।” আরও এক দোকানদারের দাবি, ‘‘লাইসেন্স থাকলে সমস্ত নিময়কানুন তো মানতে হবে। প্রশাসন কোনও চাপ দেয়নি। বেআইনি জেনেও অ্যাসিড কিনছি ও বিক্রিও করছি।’’

অ্যাসিড ব্যবহার এবং কমবেশি দোকানে রাখার কথা স্বীকারও করেছেন ঘাটাল স্বর্ণ শিল্পী ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী ওয়েলফেয়ার সমিতির সংগঠনের সম্পাদক কার্তিক আধিকারী। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের অল্প অ্যাসিড লাগে। গালাই দোকানেই বেশি ব্যবহার হয়। কোথা থেকে লাইসেন্স পাওয়া যাবে তা আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের কেউ বিক্রি করে না। স্থানীয় হার্ডওয়ারের দোকান থেকে প্রয়োজন মতো অ্যাসিড কিনি।”

সূত্রের খবর, ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে এক মহিলার দায়ের করার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালত বেশ কিছু নিয়মের উল্লেখ করে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্য সরকার ওই বছরই নভেম্বর মাসে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে অ্যাসিড বিক্রি-সহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে মহকুমা পুলিশ অফিসার ও মহকুমাশাসকের হাতে অবাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্যে এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য অভিযান চোখে তেমন পড়েনি। উল্টে বাড়ছে যত্রতত্র অ্যাসিড বিক্রির দোকান। সরকারের হুঁশ না থাকায় উদ্বেগে সাধারণ মানুষও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “নন্দনপুরে ঘটনার পর অভিযান চালিয়েছিলাম। বিক্রি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফের তদন্ত চালাচ্ছি।”

পুলিশ আধিকারিকদের একাংশের কথায়, “সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে। তা না হলে অ্যাসিড বিক্রির নাগাল টানা সম্ভব নয়।” সব ঘটনা শুনে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক জগদীশ প্রসাদ মীনার দাবি, “এ বার যাতে লাইসেন্স ছাড়া অ্যাসিড ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়-তার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement