শূন্যতা। ম্যারাপ বঁাধা হয়েছিল দুলকি গ্রামে বরের বাড়িতে। তবে বৌভাত আর হল না।
বাড়ি জুড়ে খাঁ খাঁ নিস্তব্ধতা। দুলকি গ্রামে মাটির বাড়ির দাওয়ায় থম মেরে বসে রয়েছেন বছর তেইশের শ্যামল মুর্মু। পাশে সদ্য বিবাহিতা শ্যামলীও ।
মাটির বাড়ির নিকোনো দেওয়ালে আদিবাসী প্রথায় আলপনা আঁকা। অতিথি আপ্যায়ণের জন্য বাড়ির উঠোনে খাটানো সামিয়ানা ফাঁকাই পড়ে। ভিয়েনের আঁচ নেভানো উনুনে লোহার কড়াইটা চাপানো। বৌভাতের উৎসব বদলে গিয়েছে মৃত্যুশোকে।
দুলকি গ্রামের বলরাম মুর্মুর ছোট ছেলে শ্যামলের বিয়েতে নেমন্তন্ন ছিল গোটা গ্রামের। বুধবার রাতে পুরুলিয়ার বোরো থানার বড় কদম গ্রামে কনের বাড়িতে শ্যামলের বিয়ের অনুষ্ঠানে গোটা দশেক গাড়িতে করে শ’খানেক বরযাত্রী গিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি পিক আপ ভ্যানে ছিলেন জনা তিরিশ বরযাত্রী। বৃহস্পতিবার সকালে কনে নিয়ে ফেরার সময় সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল।
বেলপাহাড়ির তামাজুড়ির কাছে আমতলায় বরযাত্রী নিয়ে ওই পিকআপ ভ্যানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার ধারে একটি জাম গাছে ধাক্কা মেরে উল্টে যায়। ঘটনাস্থলেই ৬ জনের মৃত্যু হয়। পরে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় জখম হন ২৪ জন।
মৃতদের তালিকায় রয়েছে বেলপাহাড়ির মুড়ানশোল গ্রামের ধরমবীর মাণ্ডি (৩০), সঞ্জীব মুদি (২৭), দুলকি গ্রামের সিদ্ধেশ্বর মাহালি (৩৫), ধুলিয়াপাড়ার এভেন হাঁসদা (২৩), নয়নাগড়ার বুদ্ধেশ্বর বাস্কে (১৮), লক্ষ্মীরাম মুর্মু (২০), বাঁকুড়ার বারিকুলের স্কুল পড়ুয়া আনন্দ হাঁসদা (১৫) ও ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়ার পটাশমারা গ্রামের সরোজ মাণ্ডি (৩৬)। মৃতদের মধ্যে সরোজ মাণ্ডি ও এভেন হাঁসদা হলেন শ্যামলের দুই সম্পর্কিত মামা। বাকিরা বন্ধুবান্ধব ও পাড়াপড়শি। পিকভ্যানটির চালকও আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
জখমরাই জানালেন, সকাল ছ’টা নাগাদ বরযাত্রী বোঝাই পিকআপ ভ্যানটি রওনা হয়েছিল। মাঝ রাস্তায় পিকআপ ভ্যানটির তেল শেষ হয়ে যায়। বান্দোয়ানের তালপাত এলাকায় গাড়িতে তেল ভরে ফের রওনা দেন তাঁরা। অন্য গাড়ি গুলির তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকায় গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন চালক। সকাল সাতটা নাগাদ তোমাজুড়ির কাছে আমতলায় রাস্তার বাঁকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, দ্রুত গতিতে যাওয়ার সময় পিকআপ ভ্যানের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় দুর্ঘটনাটি ঘটে।
এমন ঘটনায় বেলপাহাড়ির দুলকি ও আশেপাশের গ্রামগুলিতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাতিল করা হয়েছে বৌভাতের প্রীতিভোজ। আচমকা শ্যামলের দিদি মল্লিকা মাণ্ডি ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, “কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল, শখ ছিল ভাইয়ের বিয়েতে খুব আনন্দ করব।’’
দুলকি গ্রামের মৃত সিদ্ধেশ্বর মাহালির স্কুল পড়ুয়া ছেলে বছর বারোর সুশান্তও বাবার সঙ্গে বিয়ে বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। যেতে দেননি সিদ্ধেশ্বরবাবুর স্ত্রী রুমাদেবী। তিনি বললেন, “উনি তো সব ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ছেলেটাও গেলে যে কী হত!” মুড়ানশোলের বাড়িতে ঘনঘন মূর্চ্ছা যাচ্ছেন পেশায় গাড়ি চালক সঞ্জীব মুদির মা পদ্মাবতী মুদি। কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, “পাত্র শ্যামলের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে বরযাত্রী গিয়েছিল ছেলে। ওভাবে যেতে বারণ করেছিলাম। ছেলে কথা শোনেনি।” মৃতের তালিকায় রয়েছেন মুড়ানশোল গ্রামের দিনমজুর ধরমবীর মাণ্ডি। ভাঙা কুঁড়েঘরে দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে নিথর বসেছিলেন ধরমবীরের স্ত্রী বৃহস্পতিদেবী।
এমন দুর্ঘটনার পরে দুলকি গ্রামে শ্যামলের গোটা পরিবার বাকরুদ্ধ। আহতদের মধ্যে শ্যামলের ভাগ্নে মহেন্দ্র মাণ্ডি আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঝাড়গ্রামে চিকিৎসাধীন।
কিন্তু এসব তো আর বোঝে না শ্যামলের দুই খুদে ভাইপো রাহুল আর লক্ষ্মীকান্ত। কাকিমাকে নিয়ে কাকা বাড়িতে এসেছে। অথচ বৌভাতের দিনে সবার চোখে কেন জল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তারা।
ছবি: দেবরাজ ঘোষ।