কঙ্কাল: এই গাড়িটিতেই গয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন সুদীপরা। ট্রেলারে ধাক্কা মেরে একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে সেটি। —নিজস্ব চিত্র।
মাস পাঁচেক আগে একমাসের ব্যবধানে বাবা আর মা-কে হারিয়েছিলেন ৩১ বছরের সুদীপ বাগ। ঘাটাল থানার কোমরা গ্রামের বাসিন্দা সুদীপ সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ করতেন। একমাত্র ছেলে মনস্থ করেছিলেন গয়ায় গিয়ে বাবা-মার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দান করে আসবেন।
প্রতিবেশী অণিমা মান্নার (৩৫) চোদ্দ বছরের মেয়েও সম্প্রতি জলে ডুবে মারা গিয়েছে। সেই শোক সামলে উঠে তাঁর মনে হয়েছিল মেয়ের নামে পিণ্ড দিয়ে আসার কথা। তাই স্বামী শ্রীকান্ত মান্না, ন’বছরের ছেলে প্রীতম আর বাবা গোপাল সামন্তর সঙ্গে তিনিও যাচ্ছিলেন গয়া।
তবে সুদীপের বাবা-মা বা অণিমাদেবীর মেয়ের স্মৃতির উদ্দেশে পিণ্ড দেওয়া হয়নি। ঝাড়খণ্ডের গিরিডি জেলায় এক পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে সুদীপ, অণিমা-সহ পাঁচ জনের। জানা গিয়েছে, হুগলির আরামবাগ থানার নিরঞ্জনবাটির বাসিন্দা মহেন্দ্র ভুক্তা (৬০) নামে এক ব্যক্তিই উদ্যোগী হয়ে সকলকে নিয়ে গয়া যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আরামবাগের রাংতাখালির বাসিন্দা সুদিন ঘোড়ই (৪০) ও তাঁর ভাইপো ইন্দ্রজিৎ ঘোড়ইও। ভাড়ার গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন আরামবাগের ডঙ্গল এলাকার বাসিন্দা অর্পণ ভট্টাচার্য (৩০)। মৃত্যু হয়েছে অর্পণ এবং সুদিনবাবুর। শ্রীকান্ত মান্না, গোপাল সামন্ত ও ইন্দ্রজিৎ ঘোড়ই গুরুতর জখম। তবে রক্ষা পেয়েছে ছোট্ট প্রীতম। তার চোটও তেমন গুরুতর নয়।
সূত্রের খবর, মঙ্গলবার বিকেল ৬টা নাগাদ ওই আটজন গাড়ি নিয়ে গয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। ডুমরি পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার ভোর ৩টে নাগাদ ডুমরিটাঁড়ের কাছে জিটি রোডে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রেলারে ধাক্কা মারে গাড়িটি। আহতদের চিৎকারে ছুটে আসেন আশপাশের বাসিন্দারা। ঘটনাস্থলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক ট্রাকচালক বলেন, ‘‘প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। দিয়ে দেখি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে একটা গাড়ি। ভিতর থেকে আর্তনাদ করছেন আহতরা।’’ প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, গাড়ির অনেকটা দুমড়ে গিয়েছিল। আহতদের ভিতর থেকে বের করতে সময় লাগে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় চালক-সহ পাঁচ জনের। বাকিদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করায় ডুমরি থানার পুলিশ।
বুধবার সকালেই দুর্ঘটনার খবর পৌঁছয় কোমরা ও রাংতাখালিতে। ইতিমধ্যেই ওই সব পরিবারের সদস্যরা রওনা দিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের উদ্দেশে। গ্রামে দেহ নিয়ে ফিরতে ফিরতে বৃহস্পতিবার হয়ে যাবে বলেই খবর। কোমরার বাসিন্দা অংশুমান ধন বলেন, “আমাদের গ্রামের তিন জন ইতিমধ্যেই ডুমরি শহরে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁদের কাছেই সব খবর পেয়েছি। আগে শুনেছিলাম সকলেই মারা গিয়েছেন। কিন্তু বাচ্চাটা বেঁচে আছে, এ টুকুই আশার কথা।’’
দুই জেলার দুই গ্রামেই এ দিন সকাল থেকে শোকের ছায়া। পাড়ার মোড়ে মোড়ে মানুষের জটলা। এমন এক দুর্ঘটনায় মুখের ভাষা হারিয়েছেন সকলেই। কোমরা গ্রামে সুদীপ বাগের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল দরজা তালা ঝুলছে। তাঁর এক আত্মীয় সুচাঁদ সামন্ত বললেন, “একমাত্র ছেলে সুদীপ। কয়েক মাস আগেই বাবা, মা মারা গিয়েছে। আর কেউ নেই বাড়িতে। ওই তালা আর কে খুলবে।”
ছেলে-বৌমার দুর্ঘটনার কথা সঠিক জানেন শ্রীকান্তবাবুর মা অনিলা মান্না। ক’দিন আগেই নাতনিকে হারিয়েছেন। তাই বাড়িতে ভিড় দেখে অনেক কিছুই আঁচ করেছেন তিনি। আশপাশে সকলকে বারবার বলেছেন, ‘‘বৌমার সঙ্গে কথা বলব। ফোন ধরে দাও না।’’
এ দিনই কোমরা গ্রামে যান সুলতানপুর পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান কার্তিকচন্দ্র ঘোষ ও বিধায়ক শঙ্কর দোলইয়ের প্রতিনিধি। রাংতাখালি গ্রামে গিয়েছিলেন আরামবাগ ব্লকের সালেপুর-২ পঞ্চায়েতের প্রধান ময়না দাসের স্বামী নিমাই দাস। তাঁরা নিজেরাই ডুমরি থানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজ নিয়েছেন জখমদের। যতটা সম্ভব নির্বিঘ্নে মৃতদেহগুলি গ্রামে আনা যায়, সে বিষয়ে আশ্বাস দেন তাঁরা।