কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ঝর্না। ছবি: উদিত সিংহ
পেশায় পরিচারিকা। পঞ্চায়েতের প্রধান। পাশাপাশি, অসুস্থ স্বামীর পরিচর্যা, সংসার সামলানো থেকে শুরু করে, উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন বছর পঁয়তাল্লিশের ঝর্না রায়। পূর্ব বর্ধমানের মেমারির বিজুর ২ পঞ্চায়েতের প্রধান ঝর্না দু’বারের নির্বাচিত তৃণমূল সদস্য। তাঁর সততার কথা মানেন বিরোধীরাও।
ভোর ৫টায় উঠে ঘরের কিছু কাজ সেরে পাশের বাড়িতে কাজ করতে যান ঝর্না। ফিরে, স্বামীর যত্নআত্তি করে রওনা দেন পঞ্চায়েতে। বিকেলে ফিরে আবার একটি বাড়িতে কাজে যান। খড়ের চাল, অ্যাসবেস্টসের ছাউনির বাড়িতে বসে ঝর্না জানান, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই বিয়ে হয়। এখন তাঁর দুই মেয়েও বিবাহিত। স্বামী নীলু রায় কয়েক বছর ধরে কিডনি, হৃদরোগের সমস্যায় শয্যাশায়ী। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। তিনি বলেন, ‘‘প্রধান হয়েও লোকের বাড়ি কাজ করায়, অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু তাতে আমার পেট ভরবে না, ওষুধের টাকাও আসবে না। পঞ্চায়েত প্রধানের ভাতায় এত কিছু হয় না। তা ছাড়া,পদ না থাকলে কী করব! তাই কাজ ছাড়িনি। মাসে দু’হাজার টাকা আয় হয় তাতে।’’
পঞ্চায়েতের বিভিন্ন সভায় হাজির থাকা, প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়সাধন, উন্নয়নমূলক কাজ, সামাজিক প্রকল্প রূপায়ণ করা প্রধান হিসাবে তাঁর দায়িত্ব। স্থানীয় বাসিন্দা রাজলক্ষ্মী ঘোষ, ভগবতী পালেরা বলেন, ‘‘রাস্তা, নর্দমা গড়া থেকে শুরু করে, এলাকায় সাংস্কৃতিক চর্চার দিকেও প্রধানের নজর রয়েছে। জাবুই-মেল্লা গ্রামে নাট্যমঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন উনি। পানীয় জলের ব্যবস্থাও করছেন।’’
এলাকার বিজেপি নেতা বিশ্বজিৎ পোদ্দার বলেন, ‘‘উনি পরিচারিকার কাজ করেন। তবে সে জন্য প্রধানের কাজে প্রভাব পড়ে না।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশেষ কোনারের মন্তব্য, ‘‘অর্থনৈতিক প্রশ্নে ওই প্রধানের স্বচ্ছতা রয়েছে।’’ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মহম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘‘ঝর্নার জন্য আমরা গর্বিত।’’
২০১৮-য় প্রধান হওয়ার পরে, মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন ঝর্না। এখন উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি, বর্ধমানে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। কেন? ঝর্নার দাবি, ‘‘এখন সবই কম্পিউটারে করতে হচ্ছে। ভাল করে পঞ্চায়েত চালাতে গেলে, পড়াশোনা দরকার। সেটা বুঝেই মাধ্যমিক দিয়ে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করেছি। এখন উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’ মহকুমাশাসক (বর্ধমান দক্ষিণ) কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল বলেন, ‘‘প্রধান হওয়ার পরে নিজের আগ্রহে উনি যে ভাবে পড়াশোনা করছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।’’
নীলু বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত হোক বা বাড়ি—কোনও কাজে অবহেলা নেই। আমার দেখভালেও ফাঁক নেই। স্ত্রীকে দেখে অবাক হই।’’ বর্ষায় ছাদ দিয়ে জল পড়ে। কিন্তু সরকারি অনুদানে বাড়ি করবেন, ভাবেন না ঝর্না। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়ি করতে পারলে এমনিই পারব। কিন্তু পদ চলে যাওয়ার পরে, যেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারি।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।