জীবনদায়ী ওষুধ

দাম নাকি কমেছে, মালুম হচ্ছে না দোকানে

মার্চ মাস থেকে জীবনদায়ী বেশ কিছু ওষুধের দাম কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ধাপে ধাপে তিন বার কমানো হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম। কিন্তু বহু দোকানে তা এখনও বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। জীবনদায়ী ওষুধ কিনতে গিয়ে এখনও তাই চাপের মুখে সাধারণ মানুষ।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৬ ০৩:৪৪
Share:

মার্চ মাস থেকে জীবনদায়ী বেশ কিছু ওষুধের দাম কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ধাপে ধাপে তিন বার কমানো হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম। কিন্তু বহু দোকানে তা এখনও বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। জীবনদায়ী ওষুধ কিনতে গিয়ে এখনও তাই চাপের মুখে সাধারণ মানুষ।

Advertisement

এমনিতেই কোন, কোন ওষুধের দাম কমেছে, বেশির ভাগ মানুষ তা জানেন না। আর যাঁরা খবর রাখেন, তাঁদের অনেককে দোকানে গিয়ে দোকানির সঙ্গেই বচসায় জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। শেষমেশ অবশ্য পুরনো দামেই ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবের এই ফারাক কেন? ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা এবং খুচরো-পাইকারি ওষুধ বিক্রেতাদের অতিরিক্ত লোভ, নাকি তাঁদেরও অন্য কোনও সমস্যা রয়েছে?

ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলির একটা বড় অংশের দাবি, সরকারের ঘোষণামাত্রই আচমকা বাজার থেকে ওষুধ তুলে নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, এতে বিশাল পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। লোকসান করে সরকারি নির্দেশ মানা সম্ভব নয় বলে নির্মাতা সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওষুধ নির্নাতা সংস্থার এক প্রতিনিধির মন্তব্য, ‘‘সরকার তো আমাদের ক্ষতিপূরণ দেবে না। তাই ওষুধের যে সব ব্যাচ ইতিমধ্যে বাজারে রয়েছে তা না-ফুরনো পর্যন্ত পুরনো দামই নেব।’’

Advertisement

গত মার্চ মাসেই কেন্দ্রীয় সার ও রাসায়নিক মন্ত্রকের অধীন ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ (এনপিপিএ) ৫৩০ রকম ওষুধের দাম বেঁধে দেয়। মে মাসে আরও ১৩ রকম এবং গত ৫ জুন ৫৬ রকম ওষুধের দাম এই ভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, স্নায়ুর রোগ, রক্তের রোগ, কিডনির রোগ, হৃদরোগ, রক্তচাপ, ডায়ারিয়া, ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত সংক্রমণের ওষুধ রয়েছে।

১৩ এপ্রিল ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলি এনপিপিএ-র কাছে একটি আবেদন জানিয়ে বলে, রাতারাতি বাজার থেকে পুরনো ওষুধ তুলে পরিবর্তিত দামে ওষুধ সরবরাহ সম্ভব নয়। এর জন্য সময় দেওয়া হোক। সেই আবেদনের ভিত্তিতে এনপিপিএ ৪৫ দিনের সময়সীমা দেয়। জানিয়ে দেয়, এই সময়ের ভিতর পুরনো ওষুধগুলি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে কমে যাওয়া দাম প্যাকেটের গায়ে লিখে নতুন ব্যাচ ছাড়তে হবে। আর যদি সেটা সম্ভব না হয়, তা হলে ওষুধ নির্মাতারা পরিবর্তিত দামের তালিকা খুচরো ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। ওষুধের গায়ে যা-ই দাম লেখা থাক না কেন, বিক্রেতাকে ওই নতুন তালিকা অনুযায়ী তখন ওষুধের নতুন দাম নিতে হবে।

৪৫ দিনের হিসেবে মার্চ মাসে যে ওষুধগুলির দাম কমেছে তাদের পরিবর্তিত দাম এপ্রিলের শেষে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু জুন মাসেও সেই সব ওষুধ পুরনো দামেই কিনতে হচ্ছে।

এনপিপিএ-তে জমা পড়া বিভিন্ন দোকানের বিল থেকে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার শ্যামপুকুরের একটি দোকান গত ২৫ মে রক্তচাপের ১০টি ওষুধের একটি প্যাকেটের দাম নিয়েছে ১৪৭ টাকা, অথচ তার দাম নেওয়ার কথা ৯৬ টাকা। বর্ধমানের তেঁতুলতলার একটি দোকান গত ১৭ মে স্নায়ুরোগের একটি ওষুধের দাম নিয়েছে ১৬৪ টাকা। অথচ এর দাম নেওয়ার কথা ১৫৩ টাকা। হাওড়ার একটি দোকান গত ১৭ মে একটি স্নায়ুর ওষুধের দাম নিয়েছে ২৫ টাকা। যার দাম কমে আদতে হয়েছে ১৫ টাকা। ভবানীপুরের একটি দোকান ওই দিনই একটি অ্যান্টিবায়োটিকের দাম নিয়েছে ১০৩ টাকা, যার আসলে দাম নেওয়ার কথা ৫৬ টাকা। এই রকম প্রচুর বিল রয়েছে।

কেন এ রকম হচ্ছে? এনপিপিএ-র অধিকর্তা (প্রাইজিং এর দায়িত্বপ্রাপ্ত) অমর পাল সহানির কথায়, ‘‘আমাদের কাছে অভিযোগ জানালে খতিয়ে দেখব পুরো বিষয়টা। শাস্তি হিসেবে মোটা টাকা জরিমানা ধার্য করতে পারি।’’ কিন্তু এনপিপিএ আদতে কী? কী ভাবে তাদের কাছে অভিযোগ জানাতে হয়? এ সব কি সাধারণ মানুষকে জানানোর ব্যবস্থা রয়েছে? অমর পাল সহানি বলেন, ‘‘আমাদের ওয়েবসাইটে সব লেখা আছে।’’ এনপিপিএ খায় না মাথায় দেয়, সেটা বেশির ভাগ মানুষই জানেন না। তার আবার ওয়েবসাইট? এ ব্যাপারে সহানি নিরুত্তর।

কোন, কোন ওষুধের দাম কমেছে তা মানুষ জানবেন কী করে? ওষুধের দোকানগুলিতে কেন প্রকাশ্যে টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে না ওই সব ওষুধের তালিকা? এরও জবাব ছিল না সহানির কাছে। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা

এবং খুচরো-পাইকারি ওষুধ বিক্রেতারা কী বলছেন?

দেশে ভারতীয় ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলির অন্যতম সংগঠন ইন্ডিয়ান ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল টি আর গোপালকৃষ্ণণের ব্যাখ্যা, ‘‘বাজারে যে ব্যাচগুলি রয়েছে সেগুলি তুলে নেওয়া হলে হঠাৎ করে ওষুধের আকাল দেখা দেবে। আবার ওষুধে নতুন দামের স্টিকার লাগাতেও সময় লাগবে।’’ তা হলে কি এ ভাবেই চলবে? গোপালকৃষ্ণণ বলেন, ‘‘আমরা স্টকিস্টদের কাছে নতুন দামের তালিকা পাঠাচ্ছি। সেখান থেকে পাইকারি বিক্রেতা-ডিস্ট্রিবিউটর

হয়ে খুচরো বিক্রেতাদের কাছে তালিকা ও নির্দেশ পৌঁছতে সময় তো লাগবেই। তার পর বিক্রেতারা নতুন তালিকা অনুযায়ী দাম নেবেন।’’

এ রাজ্যে ওষুধের দোকানের মালিকদের বৃহত্তম সংগঠন ‘বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি শঙ্কর আইচের যুক্তি, ‘‘কয়েক মাসের মধ্যে ওষুধের প্রায় ১৬ হাজার ব্র্যান্ডের দাম কমেছে। কিন্তু মাত্র কয়েকটি বড় ওষুধ প্রস্তুকারী সংস্থা পরিবর্তিত দামের তালিকা পাঠিয়েছে। অনেকে পুরনো মাল ফেরত নিচ্ছে না। কেউ আবার নতুন ব্যাচেও পুরনো দাম লিখে পাঠাচ্ছে। আমরা কী করব?’’

এই অবস্থা রুখতে ড্রাগ কন্ট্রোলের কি কোনও ভূমিকা নেই? ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেল অব ইন্ডিয়া জ্ঞানেন্দ্র সিংহ দাবি করেছেন, ‘‘সেই সব ওষুধের দামই কমানো হয়েছে যেগুলির মাত্রাতিরিক্ত দাম করে রাখা ছিল। তাই দাম কমালে সংস্থাগুলির লোকসান কোনও ভাবে হবে না। খুচরো-পাইকারি বিক্রেতারা ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাকে মাল ফেরত দিলে দাম ফেরত পেয়ে যাবেন। তাই তাদেরও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’ জ্ঞানেন্দ্র সিংহ জানান, একটু সময় হয়তো লাগছে। কিন্তু ওষুধের দোকানগুলিকে কেন্দ্রের নির্ধারিত দামেই ওষুধ বেচতে হবে। এ ব্যাপারে নজরদারি চালাতে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement