মাতৃভূমি লোকালে তোলা ফাইল চিত্র।
তদন্ত এখনও পুরোপুরি শুরুই হল না। তার আগেই ফল জানিয়ে দিলেন পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার আর কে গুপ্ত। হিন্দমোটর স্টেশনে মাতৃভূমি লোকাল-কান্ড নিয়ে তাঁর অভিমত, ‘‘হাওড়ার মাতৃভূমি লোকালে এক যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় কনস্টেবলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্যি নয়। ওটা গুজব।’’
মঙ্গলবার রাতে হাওড়া মাতৃভূমি লোকালে এক পুরুষ যাত্রী উঠে পড়ায় তাঁকে ঠেলে ফেলার অভিযোগ উঠেছে এক মহিলা আরপিএফ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে। ওই মহিলা কনস্টেবলের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে মামলাও দায়ের করেছে জিআরপি। সেই তদন্ত সবে শুরু হয়েছে। রেলের তরফে যে বিভাগীয় তদন্তের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল তা এখনও শুরুই হয়নি। এমতাবস্থায় কী ভাবে পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার ওই মহিলা কনস্টেবলকে নির্দোষ আখ্যা দিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে আর কে গুপ্ত ঠিক কী বলেছেন রেল মন্ত্রকও সেই ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছে বলে রেল সূত্রের খবর। মৃত দীপু শর্মার পরিবার আদালতে যাওয়ার কথ ভাবছে।
পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারের মন্তব্য এবং রেলের মনোভাব দেখে স্তম্ভিত দীপুর পরিবার। মৃতের জামাইবাবু ভবানীপ্রসাদ শর্মা বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘এমন অবিবেচক মন্তব্য করার আগে পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারের অন্তত ৫০ বার ভাবা উচিত ছিল। আমরা দু-এক দিন সময় দিচ্ছি। পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারের বক্তব্য এবং রেলের অমানবিক ব্যবহারের জন্য যদি রেল মন্ত্রক ক্ষমা না চায় তাহলে আমরা মানবাধিকার কমিশন এবং আদালতের দ্বারস্থ হব।’’
পূর্বরেল-কর্তৃপক্ষ এবং আরপিএফ গোটা ঘটনাটির দায় মৃত যুবকের উপরে চাপালেও দীপুর স্ত্রী সুষমা শর্মা এদিন বলেন, ‘‘এক মহিলা কনস্টেবলই আমার স্বামীকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ওই কামরায় যে সব মহিলা যাত্রীরা ছিলেন, তাঁরাও একই কথা বলছেন। শুধু রেলই অন্য কথা বলছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়া দূরে থাক, তারা আমার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ পর্যন্ত করেনি।’’ দীপুর এক আত্মীয় বলেন, রেলের জেনারেল ম্যানেজার ও অন্য কর্তারা আহত কনস্টেবলদের দেখতে হাসপাতালে যেতে পারেন, কিন্তু আমাদের বাড়িতে এসে সমবেদনা জানানোর সময় বের করতে পারেন না।’’
মঙ্গলবার রাতে মাতৃভূমি লোকালের ঘটনার পরে বুধবার সকালে অভিযুক্ত আরপিএফ কনস্টেবল রজনীগন্ধা নস্করকে বিআরসিংহ হাসপাতলে দেখতে গিয়েছিলেন পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার আর কে গুপ্ত। মাতৃভূমি-কাণ্ড নিয়ে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেওয়াতেই মৃত্যু হয়েছে ওই ব্যক্তির। আর চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে গুজবের জেরে।’’ কীসের ভিত্তিতে জেনারেল ম্যানেজারের এমন মন্তব্য করলেন সেই ব্যাপারে রেল কিন্তু নিরুত্তর। তারা এখন বলছে, ‘‘তদন্ত শেষ হোক। তখনই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’’
দীপু শর্মার বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে কনস্টেবল রজনীগন্ধা নস্করের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করেছে জিআরপি। সেই তদন্তের কী অবস্থা?
তদন্তকারীরা জানান, অভিযুক্ত কনস্টেবলের দুই সহ কর্মীর সঙ্গে কথা হয়েছে। কথা হয়েছে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গেও। মূল অভিুক্তের সঙ্গে এখনও কথা বলা বাকি। রেল পুলিশ সূত্রের খবর, শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ওই মহিলা আরপিএফ কনস্টেবল তদন্তকারী পুলিশকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। শিয়ালদহের বিআরসিংহ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটেই ভর্তি রয়েছেন তিনি। তবে এদিন রজনীগন্ধার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
জিআরপি সূত্রের খবর, দুটি সূত্রের উপরে নির্ভর করে এগোচ্ছে পুলিশি তদন্ত। দীপু শর্মাকে ছেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল (মৃতের পরিবার এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকে যা বলছেন), না কি দীপু শর্মা নিজেই চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়েছিলেন (রেল পুলিশ এবং পূর্ব রেল যা বলছে)। আরপিএফ কর্তা এবং পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার আগ বাড়িয়ে আত্মহত্যার কথা বলে দেওয়ায় তদন্ত কি প্রভাবিত হবে না? রেল এবং আরপিএফ কি ওই অভিযুক্ত কনস্টেবলকে আড়াল করতে চাইছে?
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে যাতে কোনও প্রশ্ন না ওঠে তাই আমরা যথা সম্ভব বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। ওই মাতৃভূমি লোকালের চালক, গার্ড, হিন্দমোটর স্টেশনের কর্তব্যরত অফিসার, ও স্টেশনে থাকা অপেক্ষমান যাত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কামরার যতো বেশি সম্ভব প্রত্যক্ষর্শীর সঙ্গে আমরা কথা বলতে চাইছি।’’ বিভিন্ন তদন্তের সময়ে যেমন সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে রেল প্রত্যদর্শীদের বয়ান দেওয়ার আর্জি জানায়, মাতৃভূমি-কাণ্ডে কিন্তু এখনও তা করেনি রেল।
তদন্ত নিয়ে কোনও বিতর্কে যতে চাননি রেল পুলিশের এডিজি মৃত্যুঞ্জয় কুমার সিংহ। এদিন তিনি বলেন,‘‘মঙ্গলবারের ঘটনায় চারটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। খুনের মামলার পাশাপাশি ওই মহিলা পুলিশকর্মীকে নির্যাতনের মামলাও দায়ের করে তদন্ত শুরু হয়েছে। এর বেশি আর কিছু এখন বলা যাবে না।’’