ভাঙন কি গ্রামেও, উঠছে প্রশ্ন

দল ছেড়ে লোক টানতে ভরসা প্রশাসন

দলের সমাবেশ হোক বা প্রশাসনিক জনসভা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কোনও অনুষ্ঠানে এত দিন মাঠ ভরিয়ে এসেছেন তাঁরাই। কিন্তু এখন হাওয়া অন্য রকম! তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বদলে সেই দায়িত্ব এ বার দেওয়া হয়েছে সরকারি কর্মীদের হাতে। বর্ধমানে ‘মাটি তীর্থ কৃষিকথা’ উৎসবে লোক জড়ো করার কাজে দলকে এড়িয়ে যাওয়া নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে তৃণমূলের অন্দরেই।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩২
Share:

সরকারি উৎসব প্রাঙ্গণে তৃণমূলের মুখপত্রের স্টল। তবে এ নিয়ে মুখে কুলুপ সরকারি কর্তাদের। ‘মাটি তীর্থ’-এ উদিত সিংহের তোলা ছবি।

দলের সমাবেশ হোক বা প্রশাসনিক জনসভা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কোনও অনুষ্ঠানে এত দিন মাঠ ভরিয়ে এসেছেন তাঁরাই। কিন্তু এখন হাওয়া অন্য রকম! তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বদলে সেই দায়িত্ব এ বার দেওয়া হয়েছে সরকারি কর্মীদের হাতে।

Advertisement

বর্ধমানে ‘মাটি তীর্থ কৃষিকথা’ উৎসবে লোক জড়ো করার কাজে দলকে এড়িয়ে যাওয়া নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে তৃণমূলের অন্দরেই। একদা লালদুর্গ বর্ধমানে গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই একচ্ছত্র দাপট তৈরি করেছে মমতার তৃণমূল। পঞ্চায়েত ভোটে বামেরা ধূলিসাৎ হয়েছে, শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ করে বর্ধমান পুরসভায় বামেদের প্রার্থী তুলে নিতে হয়েছে! এ হেন বর্ধমানে ‘কৃষিকথা’ উৎসবে লোক ভরাতে দলের উপরে মুখ্যমন্ত্রী ভরসা না রাখায় প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি গ্রামেও পায়ের তলার মাটিতে টান ধরল? বিজেপি-কে এখনও পর্যন্ত ‘শহরের সীমিত মানুষের পছন্দ’ বলেই অভিহিত করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। গ্রামবাংলা দৃঢ় ভাবে তৃণমূল নেত্রীর পাশে আছে বলেই দাবি করেন শাসক দলের নেতারা। অথচ গ্রাম-নির্ভর জেলায় গ্রামাঞ্চল থেকে ভিড় টানতেও দলকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব কীসের ইঙ্গিত, এমনই সব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজনীতির পাশাপাশি প্রশাসনিক মহলেও।

এমন ঘটনায় বেশ ক্ষুব্ধ জেলার ছোট-বড় বহু তৃণমূল নেতাই। মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী কি তাঁদের উপরে ভরসা হারালেন, সেই প্রশ্ন তুলেই কেউ বলছেন, “এর ফল ভাল হবে না!” কারও আবার বক্তব্য, “দেখেশুনে আগ্রহ হারাচ্ছি।” যদিও অনুষ্ঠানের জন্য বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী লোক জোগাড় করতে নেমে অনেক সরকারি কর্তা শেষ পর্যন্ত আবার শাসক দলের নেতাদেরই দ্বারস্থ হচ্ছেন! দলের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সে অনুরোধ এড়াতে পারছেন না তৃণমূল নেতারা। তবে ক্ষোভও চেপে রাখছেন না। ‘কৃষিকথা’ কার্যত শাঁখের করাত হয়ে উঠেছে তাঁদের কাছে!

Advertisement

কেন এ বার দলের নেতাদের উপরে ভরসা করলেন না তৃণমূল নেত্রী? সারদা-সহ নানা কাণ্ডে শাসক দল এখন জেরবার। নানা জেলায় দলের সংগঠন অনেকটাই যাঁর হাতে গড়া, সারদা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরে দলের সেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে দলনেত্রীর। তার উপরে জেলায় জেলায় প্রভাব বাড়ছে বিজেপি-র। দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা, পরিস্থিতি বিচারেই দলের উপরে হয়তো ভরসা করতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপি-র প্রভাব এবং মুকুল-আতঙ্কে বরং প্রশাসনের হাত ঘুরিয়ে নাক দেখাতে হচ্ছে!

আজ, সোমবার বর্ধমানের তালিতে সাই কমপ্লেক্স লাগোয়া মাঠে তিন দিনের এই উৎসবের সূচনা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রের ‘এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’র (এটিএমএ) টাকায় অনুষ্ঠান হবে। মাঠ ভরানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির প্রশাসনিক কর্তাদের। যাঁরা আসবেন, তাঁদের কোনও না কোনও প্রকল্পের উপভোক্তা হিসেবে দেখানোর নির্দেশও রয়েছে। কোন জেলা থেকে কত লোক আনতে হবে, বেঁধে দেওয়া হয়েছে লক্ষ্যমাত্রা। সেইমতো জেলার কর্তারা বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্লক প্রশাসনের কাছে। কাজকর্ম ফেলে সভার লোক জোগাড়ে মাঠে নেমেছেন সরকারি কর্মীরা।

মমতা-জমানার দস্তুর কিন্তু এমন ছিল না। এত দিন পর্যন্ত প্রশাসনিক কর্মসূচিতেও লোক নিয়ে যেতেন শাসক দলের নেতারাই। প্রশাসনের কর্তারা শুধু অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। কিন্তু এ বার জনসমাগমের ভারও সরকারি কর্মীদের দেওয়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হতবাক! তাঁদের কারও কারও বিস্ময়ের পালা আরও বেড়েছে, যখন প্রশাসনিক কর্তারা মাঠ ভরাতে তাঁদেরই দ্বারস্থ হয়েছেন। রবিবার সকালে বর্ধমানে তৃণমূলের এক ব্লক সভাপতি বলেন, “আজ সকালে বিডিও ফোন করে বলেন, যে ভাবে হোক শ’তিনেক লোক দিতে হবে। আমি বলেছি, কোথায় বাস দাঁড়াবে বলুন। লোক পৌঁছে যাবে!”

শাসক দলের সব স্তরে অবশ্য প্রশাসনের তরফে সাহায্য চেয়ে বার্তা আসেনি। যেমন পশ্চিম মেদিনীপুরের এক যুব তৃণমূল নেতা বলেন, “মাসদেড়েক আগে খড়্গপুরে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভাতেও আমার এলাকা থেকে লোক নিয়ে গিয়েছিলাম। এ বার তো আমাদের কিছু বলাই হয়নি। কেন কে জানে!” কালনার এক তৃণমূল নেতার বক্তব্য, “দিদি এটা কী করছেন? এ ভাবে বিডিও-দের দিয়ে লোক জোগাড় করা মানে তো দলের লোকজনের প্রতি অনাস্থা দেখানো। এতে দলের ভাল হচ্ছে না।” আর এক নেতা আবার বলেন, “বিডিও-দের কী জনভিত্তি রয়েছে যে, তাঁদের কথায় মানুষ সভায় ছুটবে? শেষে সেই আমাদেরই মাঠে নামতে হচ্ছে। এর চেয়ে সরাসরি বলতে পারত!” বর্ধমান জেলায় তৃণমূলের এক বিধায়ক বলছেন, “কে যাবে না যাবে, সে সব যখন বিডিও-রা দেখছেন, খামোখা এতে মাথা গলাব কেন? এই উৎসব নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই!”

সরকারি কর্মীরাও বিরক্তি চাপছেন না। পূর্ব মেদিনীপুরের এক বিডিও যেমন বলেন, “এর পরে যে আর কী কী করতে হবে, কে জানে!” বর্ধমানের এক বিডিও-র বক্তব্য, “আমরা কোথায় লোক পাব? শাসক দলের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে।” তাঁর আরও খেদ, “এখনও টাকা-পয়সা আসেনি। সবাই মিলে চেষ্টা না করলে কী করে হবে!”

শিলিগুড়িতে সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ উৎসবের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে ওঠার সময়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম ছিল ফাঁকা। হঠাৎ পিছু ফিরে সাজঘরে চলে যান তিনি। তড়িঘড়ি দর্শক জুটিয়ে এনে স্টেডিয়ামে ভিড় বাড়ানোর ব্যবস্থা করেন কর্তারা। তার পরে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেই রকম পরিস্থিতি এড়াতেই এ বার আগেভাগে প্রশাসনের কর্তাদের দিয়ে লোক ধরে আনার ফরমান জারি হয়েছে বলে মনে করছে বিরোধীরা। সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের দাবি, “তৃণমূল নেত্রী জানেন, মানুষ তাঁদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। সেই কারণেই দলের লোকের উপরেও ভরসা রাখতে পারছেন না তিনি। তাই প্রশাসনের অফিসারদের ছাগল দিয়ে টাকার লোভ দেখিয়ে লোক জোগাড় করতে নামিয়েছেন!”

তালিতের যে জায়গায় অনুষ্ঠান হচ্ছে, তার চারপাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় বোরো চাষ হয়। এ বছর যদিও চাষের পরিমাণ কম। অমলবাবুর দাবি, “বোরো চাষের জল নেই, নাবিধসায় আলু খেত উজাড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকারের সে দিকে নজর নেই! বরং, চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার টাকা নষ্ট করে ম্যারাপ বেঁধে হইহই হচ্ছে!”

দলনেত্রী কি দলের উপরে আস্থা হারাচ্ছেন? রাজ্যের প্রাণিসম্পদ দফতরের মন্ত্রী তথা বর্ধমান জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ বলেন, “মাটি তীর্থ অনুষ্ঠানের সঙ্গে দলকে জড়ানো ঠিক নয়। এটা সরকারি অনুষ্ঠান। তাই বিডিও-দের উপভোক্তা নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে ভালবাসি, তাঁরাও যাব।” এর পরেই তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “দল সরাসরি লোক নিয়ে গেলে তো আবার বলা হত, সরকারি অনুষ্ঠানে মাঠ ভরানো হয়েছে দলের লোক দিয়ে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement