হদিশ নেই জমি দানের ফাইলের। নিজস্ব চিত্র।
কেউ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়েছে এক টাকায়, কেউ বা জমি পেয়েছে বার্ষিক এক টাকা লিজ-ভাড়ায়। সেই জমিতে হাসপাতাল গড়লেও আইনি শর্ত অনুযায়ী অনেক বেসরকারি হাসপাতাল নিখরচায় কিছু সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। জমির বদলে নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়াকে কেন্দ্র করে সরকারের সঙ্গে ওই সব হাসপাতালের একাংশের টানাপড়েন চলছে। কোথাও জমি দানের ফাইল পাওয়া যায়নি। বিনামূল্যের চিকিৎসার হিসেব নেই কোথাও! স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা নিয়ে এমনিতেই বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের সংঘাত চলছে। তার উপরে এই জট।
২০১৭ সালের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইন অনুযায়ী (সেকশন ৭, সাব -সেকশন ৩(এস)), যে-সব হাসপাতাল তৈরির সময় রাজ্যের কাছ থেকে জমি বা অন্যান্য সুবিধা পেয়েছে, তারা বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের বহির্বিভাগে ২০% রোগীকে এবং শয্যায় ভর্তি ১০% রোগীকে নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা দেবে। স্বাস্থ্য দফতরের তালিকায় এমন হাসপাতাল আছে ৪৫টি। তার মধ্যে ১৮টি কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার। অভিযোগ, তাদের প্রায় কেউই এই আইন মেনে পরিষেবা দিচ্ছে না। সরকারকে নিখরচায় চিকিৎসার তথ্যও দেয়নি ওই সব হাসপাতাল।
এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘চলতি বছরে হাসপাতালগুলিকে তিন-তিন বার চিঠি লিখে ২০১৭-২০ পর্যন্ত নিখরচায় চিকিৎসা সংক্রান্ত সবিস্তার পরিসংখ্যান চেয়ে পাঠানো হয়েছে। সাত দিনের সময়সীমা দেওয়া হয় প্রতি বারেই। কিন্তু কোনও বারেই যথাযথ জবাব আসেনি। অনেকেই উত্তর দেয়নি। যারা দিয়েছে, তাদের উত্তরও অত্যন্ত ভাসা-ভাসা। অথচ বহু গরিব মানুষের ওই সব হাসপাতালে নিখরচায় পরিষেবা পাওয়ার কথা।’’
হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন?
স্বাস্থ্য অধিকর্তা জানান, এক জন অভিজ্ঞ অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই অফিসার বলেন, ‘‘২১ জানুয়ারি, ৮ ফেব্রুয়ারি ও ১৭ মার্চ— তিন বার আমরা ওই সব হাসপাতালকে চিঠি দিয়েছি। ওদের প্রত্যেকেরই আউটডোর ও ইন্ডোরে কিছু রোগীকে নিখরচায় দেখার কথা। কিন্তু তারা দেখে না এবং তথ্যও দেয় না।’’ তিনি জানান, স্বাস্থ্য দফতরের এমন কর্মী-অফিসার নেই, যাঁরা এই ধরনের হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তারা কত লোককে নিখরচায় পরিষেবা দিচ্ছে, তাতে নজরদারি চালাবেন। উপরন্তু ২২টি হাসপাতালকে দেওয়া জমি সংক্রান্ত ফাইল স্বাস্থ্য ভবন থেকে উধাও! তাই কড়া ব্যবস্থাগ্রহণে দেরি হচ্ছে। তবে মাসখানেকের মধ্যে ডেকে পাঠানো হবে ওই সব হাসপাতালকে।
উৎপল রায় নামে ভবানীপুরের এক বাসিন্দা গত বছর ২৩ জুন তথ্য জানার অধিকার আইনে স্বাস্থ্য দফতরে জানতে চান, সরকারের জমি পাওয়া হাসপাতালগুলি ক’জনকে নিখরচায় পরিষেবা দিল? জবাবে স্বাস্থ্য দফতর ২২ জুলাই ওই ৪৫টি হাসপাতালের তালিকা পাঠায়। তখনই স্পষ্ট হয়, হাসপাতালগুলির অনেক ফাইলের হদিশ নেই। নিখরচায় পরিষেবা দেওয়ার হিসেব নেই।
উৎপল বলেন, ‘‘২০২০ সালে ৪৫টি হাসপাতালে সমীক্ষায় দেখেছি, কেউ এই আইনের ব্যাপারে জানেন না। রোগী দূরের কথা, হাসপাতালের কর্মীরাও নিখরচায় চিকিৎসা শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন!’’
ওই তালিকায় থাকা আমরি হাসপাতালের তরফে রূপক বড়ুয়া বলেন, ‘‘ঢাকুরিয়া নিরাময় ক্লিনিকের জমি ১৯৯৩-৯৪ সালে আমরা নিয়েছিলাম বাজারদরেই। তখন সেখানে সরকারের শেয়ার ছিল ২৬%। এখন সেটা কমে ১.৮% হয়েছে। তবু সরকারি হাসপাতাল কাউকে পাঠালে তাঁকে নিখরচায় পরিষেবা দেওয়া হয়। সরকার রেফার না-করলে কী করব?’’
অ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, জমির বার্ষিক ভাড়া ৯,৮৪,১৩০ টাকা। এ বছরও তার পুনর্নবীকরণ হয়েছে। তা মেটানো হয়েছে। কত রোগী নিখরচায় দেখা হয়েছে, সেই হিসেব আছে তাঁদের কাছে। ডিসান হাসপাতালের ক্ষেত্রে সরকারি তথ্য বলছে, তারা ৯৯ বছরের লিজে জমি পেয়েছিল এবং তার বার্ষিক লিজের ভাড়া এক টাকা (প্রতি ১০ বছরে পরিবর্তনযোগ্য)। ডিসান-কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘‘আমরা জমিতে ছাড় পাইনি। সরকার কাগজ দেখাক। তা না-হলে নিখরচায় চিকিৎসার প্রশ্ন আসবে কেন?’’ সরকারি নথি আনুযায়ী ডিসানের কাছে সরকারের ১৩ কোটি টাকা পাওনা। কিন্তু ডিসান-কর্তৃপক্ষ তা মানতে চাননি।
কলম্বিয়া এশিয়া হাসপাতাল সম্প্রতি হয়েছে মণিপাল হাসপাতাল। সেখানকার কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘‘সরকার রোগী পাঠালে বিনামূল্যে পরিষেবা দেব।’’ সরকারি নথি অনুযায়ী এক টাকায় জমি পেয়েছে যাদবপুর কেপিসি হাসপাতাল। সেই সঙ্গে জমির প্রতি ডেসিমেলে ৪৫ টাকা ভাড়া। সেখানকার কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘‘সরকারের চিঠি এসেছে কি না, মনে করতে পারছি না। তবে কত রোগীকে নিখরচায় দেখছি, তার রিপোর্ট নিয়মিত সরকারকে দেওয়া হয় না।’’
মেডিকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মন্তব্য, ‘‘সরকারের থেকে আমরা জমি পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু কোনও ছাড় পাইনি। ফলে বিনা পয়সায় চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসছে না। আমাদের চুক্তিপত্রেও সে-রকম কিছু ছিল না।’’ এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনে কোথাও বলা নেই যে, সরকারের থেকে পাওয়া জমির দামে বা লিজের টাকায় ছাড় পেলে তবেই নিখরচায় পরিষেবা দিতে হবে। সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, সরকারের থেকে জমি পেলেই নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীকে নিখরচায় চিকিৎসা দিতে হবে। সেটা অনেক হাসপাতাল বুঝেও না-বোঝার ভান করছে।’’
পিয়ারলেস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, ‘‘সরকারের কাছ থেকে জমি পাইনি। আমাদের জমি দিয়েছে ইনকাম ট্যাক্স এমপ্লয়িজ কো-অপরেটিভ সোসাইটি ও এজি বেঙ্গল এমপ্লয়িজ কো-অপরেটিভ সোসাইটি। চুক্তি অনুযায়ী শুধু ওই দুই সোসাইটির সদস্যদের নিখরচায় পরিষেবা দেব। সরকারি তালিকায় জমিপ্রাপক হিসেবে কী ভাবে নাম এল, জানি না।’’