রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক কি অনেক কম? প্রতীকী ছবি।
শূন্যপদ ১০টি। আবেদনকারী প্রায় ১৬৭ জন। আবার, শূন্য পদ তিনটি। আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় ৬৭। এই দু’টি চিত্র, গত বছরের বারাসত ও আরামবাগ মেডিক্যাল কলেজের। যেখানে হাউসস্টাফের পদে চাকরি পেতে আবেদন করেছিলেন এত জন চিকিৎসক!
এ হেন পরিস্থিতির পরেও কি রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক অনেক কম, এমন যুক্তি দেওয়া যায়? অন্তত বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের তেমনই দাবি। তাদের বক্তব্য, রাজ্যে পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকলেও গ্রাম ও শহরে সমানুপাতিক হারে ডাক্তার নেই এবং তার অন্যতম কারণ, পদোন্নতি, পোস্টিং, নিয়োগে ‘জটিল সরকারি নীতি’। আবার, স্বজনপোষণ ও রাজনীতির অভিযোগও রয়েছে। শহরের এক সিনিয়র চিকিৎসকের কথায়, “সরকারি স্তরে ডাক্তার পেতে হলে, সবার আগে মান্ধাতা আমলের নিয়মের জগদ্দল পাথর সরাতে হবে। না হলে, শূন্যপদ থেকেই যাবে।”
সাড়ে চার বছরের পড়াশোনার শেষে এমবিবিএস ডিগ্রি পেয়ে, তার পরে আরও এক বছর ইর্ন্টানশিপ করার পরেই তৈরি হন এক জন ডাক্তার। তাতে অনেকটা সময় লেগে যায়। তাই পাশাপাশি তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্সের পথও খুলে দেওয়া যায় কি না, তা দেখতে স্বাস্থ্য দফতরকে প্রস্তাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যে চিকিৎসকের সংখ্যা এতই কম যে বিকল্প পথের পরিকল্পনা করতে হচ্ছে? রাজ্যে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, এমন দাবি মানতে নারাজ চিকিৎসক সংগঠনগুলি। যেমন, অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা জানাচ্ছেন, দেশে সরকারি, বেসরকারি ও স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে ৬৮০টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। যেখান থেকে প্রতি বছর অন্তত ৯০ হাজার করে নতুন ডাক্তার তৈরি হচ্ছেন। তাঁর কথায়, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ রয়েছে, প্রতি এক হাজারে এক জন করে চিকিৎসক। দেশে ৮৩৪ জন পিছু এক জন চিকিৎসক রয়েছেন। ফলে গোটা দেশেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক রয়েছে বলা চলে।”
এ রাজ্যে বর্তমানে মোট ৩২টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। তার মধ্যে সরকারি ২৫টি। সব মিলিয়ে এমবিবিএসের মোট আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৭২৫। অর্থাৎ প্রতি বছর রাজ্যে ওই সংখ্যক নতুন ডাক্তার তৈরি হচ্ছেন। সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাসের কথায়, “প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার ডাক্তার পাশ করে বেরোচ্ছেন। ফলে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে এ রাজ্যের জনগণ ও ডাক্তারের অনুপাত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকেও ছাপিয়ে যাবে।” এই প্রেক্ষিতে সজল ও মানসের প্রশ্ন, “পাশ করে বেরোনো এত ডাক্তার যাচ্ছেন কোথায়? আসলে প্রতি বছর নিয়ম করে ডাক্তার নিয়োগ না হওয়ার ফলেই প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে শূন্যপদ থেকে যাচ্ছে।”
চিকিৎসকদের অভিযোগ, চাকরির নিশ্চয়তা, গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে বাসস্থানের কাছাকাছি বিভিন্ন সুযোগসুবিধা, কর্মস্থলের পরিবেশ এবং সর্বোপরি বেতনের বিষয়ে এখনও অনেক খামতি রয়েছে। এমডি বা এমএস পাশ করার পরে এক জন চিকিৎসককে তিন বছরের বন্ড সার্ভিস করতে হয়। না হলে প্রতি বছরের হিসেবে মোট ৩০ লক্ষ টাকা সরকারকে দিতে হয়। এক সিনিয়র চিকিৎসকের কথায়, “বন্ড সার্ভিসে মাসে বেতন মাত্র ৭০-৮০ হাজার টাকা। অধিকাংশই বেসরকারিতে তার থেকে বেশি বেতন পান বলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যান।” আবার, তিন বছরের শেষে প্রত্যেকের চাকরিও নিশ্চিত নয়। সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা হয় না। সেই সময় যদি কোনও নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বার হয়, তা হলে ওই চিকিৎসক আবেদন করতে পারেন। যদিও শেষ দু’-তিন বছরে জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারও নিয়োগ হয়নি। মাস কয়েক আগে সংরক্ষিত আসনে কিছু নিয়োগ হয়েছিল মাত্র। ডেন্টাল সার্ভিসে শেষ সাত বছর নিয়োগ বন্ধ ছিল। চিকিৎসকেরা বলছেন, “চাকরি পেলে গ্রামে যেতে হবে এটা এখন অনেকেই বুঝে গিয়েছেন। কিন্তু আসল কথা হল, চাকরি কোথায়?”
রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নথিভুক্ত চিকিৎসক প্রায় ৭০ হাজার। তাঁদের মধ্যে অনেকে মারা গিয়েছেন, রাজ্য বা দেশ ছেড়ে গিয়েছেন। অনেকে আর প্র্যাকটিস করেন না। যাঁরা সরকারি চাকরিতে যুক্ত, তাঁদের বড় অংশই চুক্তিভিত্তিক। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, “ডাক্তারিতেও কলেজ ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরির পরিকল্পনা প্রয়োজন। তাতে কেরিয়ারের শুরুতেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ নিতে অনেকেই রাজি হবেন।”