রাজকীয় ঘরানার নৃত্যশৈলী শিখেছিলেন রাজবাড়িতে, রাজগুরুদের কাছেই। তার পর রাজবাড়িতেই স্কুল খুলে সেই নাচ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। মেয়েদের মধ্যে।
তিনি মণিপুরী নাচের কিংবদন্তি গুরু বিপিন সিংহ। নাচের মধ্যে দিয়ে মেয়েদের আত্মশক্তিকে খোঁজার সাধনায় এখন মেতে রয়েছেন বিম্বাবতী। গুরুজির কন্যা।
গুরুজি প্রয়াত হয়েছেন অনেক দিন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী নৃত্যশিল্পী কলাবতী দেবী, নৃত্যশিল্পী দর্শনা জাভেরি, গুরুজির মেয়ে বিম্বাবতী দেবীরা মিলে তাঁর তৈরি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, যাচ্ছেন। বিম্বাবতী বলছিলেন, দীর্ঘদিন অবধি শান্তিনিকেতন এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কলকাতায় মণিপুরী নাচের চল সে ভাবে ছিল না। “যেটুকু চর্চা হতো, তাও বেশিটাই রাবীন্দ্রিকতার আধারে। কিন্তু মণিপুরী নাচের স্বতন্ত্র ঘরানা পৃথক ভাবে চর্চা করার রাস্তাটা তৈরি করেছিলেন আমার বাবাই।” এ শহরে মণিপুরী নাচের নামী শিল্পীরা বেশির ভাগ গুরু বিপিনের ছাত্রছাত্রী।
কলকাতাতেই বড় হয়েছেন। ঝরঝরে বাংলা বলেন বিম্বাবতী। পারিবারিক ভাবে কলকাতার সঙ্গে যোগ তাঁদের বহু দিনের। খুব কম বয়সেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন বিপিন। তখন নাচের পাশাপাশি গানও গাইতেন সমান তালে। কাজ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। একটা সময়ের পরে বিপিনের মনে হয়েছিল, মণিপুরী নৃত্যশৈলী তার প্রাপ্য মর্যাদা পাচ্ছে না।
অন্য ধ্রুপদী ঘরানার নৃত্যশিল্পীরা মণিপুরীকে নিজেদের সমকক্ষ বলে মনে করছেন না। বিপিন তখন ফিরে যান মণিপুরে। মণিপুরে তখন রাজতন্ত্রের যুগ। রাজার পৃষ্ঠপোষকতাতেই বিপিন রাজগুরুদের কাছে নতুন করে তালিম নেওয়া শুরু করলেন। গুরু আমুদন শর্মার প্রশিক্ষণ পেলেন। রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন গোবিন্দজি নর্তনালয়। তার কিছু দিন পরে ১৯৭২-এ কলকাতায় গড়ে ওঠে মণিপুরী নর্তনালয়। মুম্বই আর ইম্ফলেও রইল তার শাখা। বিপিন-কলাবতী-জাভেরিদের নাম তত দিনে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে, দেশের বাইরেও।
চার দশকেরও বেশি এই যাত্রায় এ বার নিজেকে নতুন করে খোঁজার পালা। বিম্বাবতীরা এর আগে মণিপুরী নৃত্যের সঙ্গে অন্যান্য নৃত্যশৈলী মেশানোর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। কখনও ওড়িশি, কখনও কথক। এ বার তাঁরা মণিপুরের দেশজ নৃত্যঘরানার গভীরে ডুব দিতে চান। মণিপুরে বৈষ্ণব ধর্মের চলই বেশি। কিন্তু প্রাক-বৈষ্ণব যুগের প্রকৃতি পূজা, তান্ত্রিক ভাবনা, সৃষ্টিতত্ত্ব ও মাতৃতন্ত্রের ঐতিহ্যকে বৈদিক দর্শনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন বিম্বাবতীরা। তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন সংস্কৃতজ্ঞ সঙ্গীতশিল্পী সৃজন চট্টোপাধ্যায়। মহালয়ার দিনটি তাঁরা বেছে নিয়েছেন নারীর মধ্যে দেবাত্মার উপলব্ধিকে উদযাপনের জন্য। তাঁদের নৃত্যালেখ্যের নামটিও ‘দেবাত্ময়ী’।
দেবীপক্ষে এও তো আগমনীরই সুর!