রাজ্য যুব কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে গোটা সংগঠনটা তৃণমূলে চলে যায়নি প্রমাণ করতে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে যখন যুব নেতাদের হাজির করছেন অধীর চৌধুরী, দিল্লিতে দলের সর্বভারতীয় সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে কংগ্রেসে ভাঙন নিয়ে সে দিনই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন মানস ভুঁইয়া। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর যখন দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচন নিয়ে বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, এক বিধায়ক তখন জন্মু ও কাশ্মীরের আসন্ন ভোটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন! এ সবের নিট ফল প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্কট শেষ পর্যন্ত তীব্র আকার নিচ্ছে!
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে, মানসবাবুদের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রকাশ্যে কটাক্ষ করেছেন অধীর! পশ্চিমবঙ্গে দলে লাগাতার ভাঙনে উদ্বিগ্ন হয়ে সোমবার দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রের মতামত শুনেছিলেন সনিয়া। তার পর দিনই ১০ জনপথের দ্বারস্থ হয়েছেন মানসবাবু। প্রদেশ সভাপতি যখন দল থেকে নেতা-বিধায়কদের বিদায়কে বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি নন, সেই সময়ে প্রদেশ নেতাদের একাংশের দিল্লি-যাত্রাকে খুব ভাল চোখে দেখছে না অধীর-শিবির। বিধান ভবনে এ দিন অধীরের কথাতেই তার ইঙ্গিত মিলেছে। তিনি কটাক্ষ করেছেন, “সনিয়া গাঁধীরা কাউকে ডাকেন না! আমরা তাঁদের কাছে যাই।” দলের দুর্দিনে সুবিধাবাদী একটা অংশ ছেড়ে যাচ্ছে, প্রদেশ সভাপতি এই ব্যাখ্যা দেওয়ার পরেই তাঁকে মানসবাবুর সনিয়ার কাছে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। অধীরের জবাব, “মানসবাবু যদি এতই কাজের হন, তা হলে আমার জায়গায় তাঁকেই সভাপতি করে দেওয়া হোক!” যা শুনে মানসবাবুর মন্তব্য, “আমরা কেউ তো প্রদেশ সভাপতির বিরুদ্ধে নালিশ করতে যাইনি। অধীরের কোনও কাজে অসহযোগিতাও করিনি। দলের ভাঙন নিয়ে আত্মসমীক্ষার কথা বলা যাবে না? এত অল্পে ধৈর্য হারালে এবং উত্তেজিত হলে কী করে চলবে!”
বস্তুত, এআইসিসি-র তরফে রাজ্যের পর্যবেক্ষক সি পি জোশীর পরে এ বার এ দিন সকালে সনিয়ার সঙ্গে দেখা করে মানসবাবু এই কথাই বলেছেন যে, তিন বছর আগে কংগ্রেস ৪২ জন সদস্যকে নিয়ে বিধানসভায় এসেছিল। এর আগে ৬ জন এবং এখন তিন জন বিধায়ক তৃণমূলে চলে গিয়েছেন। মানসবাবুর বক্তব্য, “যখন কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের লড়াইয়ের সুযোগ এসেছে, সেই সময় এমন ঘটনা উদ্বেগজনক। বিশেষত, ছাত্র ও যুবদের চলে যাওয়া দলের ভবিষ্যতের পক্ষে অশুভ ইঙ্গিত!” তাঁর মতে, প্রদেশ নেতাদের ডেকে হাইকম্যান্ড বিচার-বিশ্লেষণ করলে ভাল হয়। প্রদেশ কংগ্রেসের আর এক বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মান্নান এ দিনই দিল্লিতে জোশীর সঙ্গে দেখা করেছেন।
অধীর কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলত্যাগের প্রেক্ষিতে প্রদেশ স্তরে তিনি কোনও আলাদা বৈঠক ডাকছেন না। বিধান ভবনে দলীয় দুই বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী ও অপূর্ব সরকারকে পাশে নিয়ে প্রদেশ সভাপতি এ দিন বলেছেন, “রাহুল গাঁধীর পরামর্শে যুব সংগঠনটা খোলামেলা করতে গিয়ে কিছু বেনোজল এসে গিয়েছে! সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে।” তৃণমূলের মুকুল রায়দের দাবি খারিজ করার জন্য ৩৪টি লোকসভার যুব কংগ্রেস সভাপতিকে এ দিন প্রদেশ দফতরে হাজির করেন অধীর। যদিও সেই ছবি টিভি-তে দেখে দলত্যাগী যুব সভাপতি সৌমিক হোসেনের দাবি, এর মধ্যে মাত্রই ৪-৫ জন প্রকৃত লোকসভা সভাপতি। বাকিরা কেউ কোনও সভাপতি পদেই নেই! সৌমিকের কটাক্ষ, “মাথা খারাপ হয়ে গিয়ে ওঁরা লোক ধরে আনছেন!”
দ্বন্দ্বের শেষ এখানেই নয়। নতুন প্রদেশ কমিটি না হওয়া পর্যন্ত সব জেলা সভাপতিতেই বহাল রাখার ঘোষণা করেন অধীর। মধ্য কলকাতায় দলত্যাগী প্রদীপ ঘোষের জায়গায় কাউকে এখনই সভাপতি করা হচ্ছে না। আর ব্যতিক্রম নদিয়া। সেই জেলায় শঙ্কর সিংহের জায়গায় অসীম সাহাকে নতুন জেলা সভাপতি ঘোষণা করা হয়েছে এ দিন। শঙ্কর কি ইস্তফা দিয়েছেন? প্রদেশ সভাপতির বক্তব্য, “ওঁর কাজ পছন্দ হয়নি বলে সরিয়ে দিয়েছি ওঁকে!” তাঁর কাজও তো কিছু প্রদেশ নেতার পছন্দ নয়! অধীরের ব্যাখ্যা, “আমার সব কিছু সবার পছন্দ হতে হবে, এমন রক্ষাকবচ নিয়ে সভাপতি হইনি! প্রদেশ সভাপতি হওয়ার জন্য আর্জিও জানাইনি।” অপসারণের খবর শুনে শঙ্করের প্রতিক্রিয়া, “আমি আনন্দিত যে, অধীর চৌধুরীর সার্টিফিকেট নিয়ে আমাকে চলতে হচ্ছে না! আমি ওঁর গোমস্তা নই!”
বিধানভায় প্রদেশ সভাপতির সঙ্গে বৈঠকে এ দিন নানা কারণে গরহাজির ছিলেন ৬ জন বিধায়ক। তার মধ্যে অধীরের জেলারই ফরাক্কার বিধায়ক মইনুল হককে নিয়ে জল্পনা চলছে। বৈঠকে অনুপস্থিত মইনুল বলেছেন, “আমার সঙ্গে কেউ কোনও কথা বলেনি। এআইসিসি জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচনে কাজ করতে বলেছে। সেটা হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ ঠিক করব।”