ছবি আঁকেন, কবিতা লেখেন, কি-বোর্ড বাজান। লিখেছেন গানও। আর এ বার পুজোর থিম সংও লিখলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই গান বাজবে তাঁরই দলের বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের পুজোয়। নিউ আলিপুরের সুরুচি সঙ্ঘের পুজোর সেই থিম সং ইতিমধ্যে রেকর্ডিংও হয়ে গিয়েছে মুম্বইয়ে। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুরে সেই গান গেয়েছেন শ্রেয়া ঘোষাল। এ বারের পুজোর থিম সংয়ের বাজারে এই ‘চমক’ নিয়েই হাজির সুরুচি সঙ্ঘ!
বস্তুত, কলকাতার পুজোয় থিমের আগমনের পরেই শুরু হয় থিম সংয়ের ব্যবহার। থিমপুজোয় দুর্গার চেনা সাবেক চেহারা বা মণ্ডপসজ্জা থাকে না। তাই দর্শনার্থীদের সঙ্গে থিমের যোগ আরও নিবিড় করতে থিম সংয়ের ব্যবহার শুরু করেন উদ্যোক্তারা। তারপরে যত দিন গড়িয়েছে, থিম সংয়ের বৈচিত্র্য, জাঁক বেড়েছে বই কমেনি।
এমনিতেই এ বার মহানগরের পুজোর হাওয়া সরগরম করে তুলেছে টিজার-তরজা। তবে সেই তরজার শুরুর দিকে সুরুচিকে তেমন ভাবে নামতে দেখা যায়নি। পরে তারা টিজার দেয়, ‘‘রাইমা ওর মাকে মাম্মি বলে, নুসরত ওর মাকে আম্মি বলে, আমি মা বলি।’’ সেই সুর টেনেই পুজোর অন্যতম কর্তা অরূপবাবু জানাচ্ছেন, তামিলনাড়ু থিমে সুরুচির পুজোর বিষয় এ বার, ‘মা’। সেই তামিলনাড়ু, যার মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা আবার নিজের রাজ্যে ‘আম্মা’ বলে পরিচিত। তামিলে ‘আম্মা’ শব্দটির অর্থও ‘মা’। মুখ্যমন্ত্রীর লেখা গানেও রয়েছে, ‘‘মা আমাদের সর্বজনীন, যাঁর নেইকো তুলনা/ মা, মাদার, আম্মা, সব একই ভাষা/ তা, কখনও ভুলোনা...।’’
থিমের পুজোর শুরুর দিকে থিম সং হিসেবে আবহসঙ্গীতের সিডি চালিয়ে দেওয়া হতো মণ্ডপে। তবে পরে তাঁরা বুঝতে পারেন পেশাদার শিল্পীরা এই কাজ অনেক ভালভাবে করতে পারবেন। তখন থেকেই পেশাদার শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালকদের দিয়ে থিম সং তৈরির কাজ শুরু। ‘‘দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে পুজো একটা ‘ইভেন্ট’ হয়ে ওঠার ফলেই থিম সং তৈরিতেও এই বদল এসেছে।’’, বলছেন এক উদ্যোক্তা।
এক দশকেরও আগে, ২০০৩-এ জনপ্রিয় হয়েছিল ‘সৃষ্টি’র (এখন বড়িশা ক্লাব) টেরাকোটা শিল্পের থিমের সঙ্গের পাঁচালি গানগুলি। শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য ও তাঁর বাবা প্রয়াত ধ্রুবদাস ভট্টাচার্য গেয়েছিলেন সেই গান। বড়িশা ক্লাবের তরফে অনিমেষ চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘বাঁকুড়ার টেরাকোটার আদলে দুর্গার সঙ্গে পাঁচালি গানেই কার্যত থিম সংয়ে নজর কাড়ে ‘সৃষ্টি’’। গুজরাত দাঙ্গার পরে সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীনের পুজোতে তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের পরিচালনায় রাঘব, রূপঙ্করের গানও প্রশংসা কুড়িয়েছিল দেদার।
দিন যত গড়িয়েছে, থিম সং দিয়ে নজর কাড়তে চেয়েছে সব পক্ষ। থিম সংয়ের জাঁকও ক্রমেই বেড়েছে। গত চার বছর ধরে সুরুচি সঙ্ঘের থিম সং গাইছেন, সুর করছেন মুম্বইয়ের শিল্পীরা। ২০১১ থেকে এ বছর পর্যন্ত সুরুচি সঙ্ঘের সব কটি থিম সংয়েই সুর দিয়েছেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। গেয়েছেন মোনালি ঠাকুর-জুবিন গর্গ থেকে শুরু করে সোনু নিগম-শান-শ্রেয়া ঘোষাল, গতবছর অরিজিৎ সিংহও। মুম্বই থেকে জিৎ বললেন, ‘‘সুরুচি সঙ্ঘ আমার নিজের ক্লাব। আমি ও আমার স্ত্রী চন্দ্রাণী এই পুজোর সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িয়ে। এ বারে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা গানে সুর করতে পারায় আমি কৃতজ্ঞ। শ্রেয়ার মতো শিল্পী গানটা গাওয়ায় সব মিলিয়ে যে তা সবার মন জয় করবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।’’ অরূপবাবু জানাচ্ছেন, ২০১১-র আগে থেকেই তাঁদের থিম সং হলেও চার বছর ধরে তাঁরা পুরোপুরি তারকা গায়কদের দিয়ে থিম সং গাওয়াচ্ছেন, যা পুজোর অন্যতম আকর্ষণ।
তবে থিম সং তৈরিতে কেবল পুজোর থিমের কথা মাথায় রাখলে হয় না। মনে রাখতে হয় পুজোটি কোন এলাকার, সেই এলাকার বৈশিষ্ট্যের উপরেও। এমনটাই জানাচ্ছেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ছেলে তবলাশিল্পী মল্লার। তিনি এ বার ছোট-বড় মিলিয়ে ২২টি পুজোর থিম সং তৈরি করছেন। তিনি বললেন, ‘‘গানের লয়, মেজাজ কেমন হবে তা একাধিকবার মণ্ডপের এলাকা, পরিবেশ, আলো সব মিলিয়ে তৈরি করতে হয়। তাহলে পুজো তার সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির হতে পারে।’’ তবে একসঙ্গে ২২টি পুজোর থিম সং করলে কি কিছু গানের মান পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়? মানতে চান না মল্লার। তাঁর যুক্তি, ‘‘উদ্যোক্তারা এত ভাল করে মণ্ডপের পরিকল্পনা, আলো, রং, প্রতিমার গড়ন সব বুঝিয়ে দেন আর কোনও সমস্যার জায়গা থাকেই না।’’
জিৎ অবশ্য থিম সংকে ধরতে চান পুজোর গান হিসেবেই। তাঁর কথায়, ‘‘একসময় পুজো মানেই ছিল নতুন অ্যালবাম। এখন তা অনেক কমে গিয়েছে। তবে প্রতি পুজোর এরকম যদি একটা থিম সং থাকে তাহলে খুবই ভাল হয়। মুম্বইতে গণেশ পুজোর মতো পুজোতেও থিম সং হয় না। সেদিক থেকে আমাদের বাঙালি হিসেবে গর্ব হওয়া উচিত এমন পুজোর গানের জন্য।’’
বিজ্ঞাপন সংস্থার তৈরি লোগো পছন্দ না হওয়ায় ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের লোগো, শ্লোগান নিজেই লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ বার তাঁর কথায় শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া গান কলকাতার পুজোর ‘থিম সং-বিধানে’ অন্য অধ্যায় যোগ করল, এমনটাই দাবি করছেন উদ্যোক্তারা।