ভিস্তারাকে ফুলের তোড়া কি টাটায় মমতার স্পর্শ

অল্প কিছু মুহূর্ত। আপাতদৃষ্টিতে শুধুই সৌজন্য। তবু তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কোনও নয়া উড়ানের ইঙ্গিত রয়ে যাচ্ছে কি না, তা নিয়েই যত জল্পনা শিল্প ও প্রশাসনিক মহলে। আগের দিনই, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাটা-গোষ্ঠীর প্রতি অভ্যর্থনার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে! বাগডোগরা বিমানবন্দরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভিস্তারা এয়ারলাইন্সের প্রথম বিমানকে স্বাগত জানিয়েছেন মমতা! ‘ভিস্তারা’, টাটা এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের যৌথ উদ্যোগের ফসল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৪
Share:

বাগডোগরা বিমানবন্দরে ভিস্তারার আধিকারিকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।

অল্প কিছু মুহূর্ত। আপাতদৃষ্টিতে শুধুই সৌজন্য। তবু তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কোনও নয়া উড়ানের ইঙ্গিত রয়ে যাচ্ছে কি না, তা নিয়েই যত জল্পনা শিল্প ও প্রশাসনিক মহলে।

Advertisement

আগের দিনই, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাটা-গোষ্ঠীর প্রতি অভ্যর্থনার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে! বাগডোগরা বিমানবন্দরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভিস্তারা এয়ারলাইন্সের প্রথম বিমানকে স্বাগত জানিয়েছেন মমতা! ‘ভিস্তারা’, টাটা এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের যৌথ উদ্যোগের ফসল।

রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের এই আপাত ছোট্ট পদক্ষেপেই দানা বেঁধেছে নতুন চর্চা। তবে কি টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে অতীতের তিক্ততায় ইতি টানতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী? সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় থেকে টাটাদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের অঘোষিত বয়কটনীতিতে কি তবে এ বার দাঁড়ি পড়বে? সিঙ্গুরের জমি-জট ছাড়াতে টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে কি আদালতের বাইরে কোনও সমঝোতার জন্য উদ্যোগী হবে রাজ্য?

Advertisement

বৃহস্পতিবার বাগডোগরায় ‘ভিস্তারা’র বিমান অবতরণের পর মুখ্যমন্ত্রীর চোখেমুখে যে খুশির উচ্ছ্বাস ধরা পড়েছে, তা দেখে শাসক দলের বহু নেতাও কিন্তু রীতিমতো চমকিত। এর আগে মমতা আলিপুরে টাটা গোষ্ঠীর পাঁচতারা হোটেলে পা রাখতে চাননি। টাটা-নির্মিত কোনও ব্র্যান্ডের গাড়ি বা ঘড়ি নিজের দলের নেতা-মন্ত্রীদের ব্যবহার করতে বারণ করতেন তিনি। টাটার তৈরি গাড়ি চড়ার জন্য দু’-এক জন নেতাকে তিরস্কারও করেছিলেন। সাংসদ সৌগত রায় টাটার এসইউভি ব্যবহার করতেন। তিনি সেই গাড়ি বছর পাঁচেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। সিঙ্গুর-পর্বে দলনেত্রীর মন পেতে এক বার নিজের হাতের টাইটান ঘড়ি মঞ্চ থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তৃণমূল বিধায়ক শীতল সর্দার।

স্পর্শকাতরতার নজির আরও আছে। এক প্রবীণ বিধায়কের কথায়, সিঙ্গুরের সময় বিধানসভার শিল্প বিষয়ক স্থায়ী কমিটির তরফে টাটার নুনের কারখানা ঘুরে এসে ইতিবাচক রিপোর্ট দিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে দল বদলিয়ে দিদির সঙ্গী হওয়ার পর থেকে টাটার প্রশস্তি আর শোনা যায়নি তাঁর মুখে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সানন্দে টাটার ন্যানো কারখানা পরিদর্শন করতে চেয়েছিল ওই কমিটি। শাসক দলের হস্তক্ষেপে সে সব ধামাচাপা পড়ে যায়।

মমতা নিজে এক সময় টাটার তৈরি লবণও ব্যবহার না-করার পক্ষপাতী ছিলেন। এত দিন পরে সেই তিনিই যখন ‘ভিস্তারা’র অভ্যর্থনায় এগিয়ে গেলেন, স্বাভাবিক ভাবেই নানা সম্ভাবনার কথা আলোচিত হচ্ছে নানা মহলে। সিঙ্গুর মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি আদালতে। শিল্প আসেনি, কৃষিও নেই— দু’দিক থেকেই নিষ্ফলা হয়ে পড়ে রয়েছে অধিগৃহীত সেই জমি। ‘টাটা ফেরাও’ আওয়াজ তুলছে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সিঙ্গুর। এই বাস্তবতা মমতার অজানা নয়। ভিস্তারার আগমনে তাঁর সৌজন্য-বার্তা কি তবে আদালতের বাইরে জমি-জট ছাড়ানোর রাস্তা খুলবে? মুখ্যমন্ত্রী কী চাইছেন?

শুক্রবার ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা আবারও বলেছেন, তাঁর দল সিঙ্গুরের জমির প্রশ্নে সমঝোতা করবে না। কিন্তু রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের নজর এড়াচ্ছে না, মমতার দিক থেকে কিছুটা ইতিবাচক সুরও। তাঁদের মতে, মমতার দিক থেকে এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলার সময় আসেনি। কিন্তু মমতা ঘনিষ্ঠদের কাছে বলেছেন, তিনি আলাদা করে টাটাদের বিরোধী নন। ঘটনাচক্রে সিঙ্গুরে টাটারা ছিল। অন্য যে কেউ থাকতে পারত।

তা হলে টাটা-বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন কেন? মমতার বক্তব্য, সিঙ্গুরের কৃষকদের স্বার্থকে মর্যাদা দিতে সেটা ছিল তখনকার আবেগের প্রতীকী প্রকাশ। এখন রাজ্যের স্বার্থে প্রয়োজন হলে তিনি টাটাদের তাজ বেঙ্গল হোটেলে যেতেই পারেন।

দলের বাকিদের জন্য কি টাটা-বয়কট নীতি উঠে যাচ্ছে তা হলে? নেতারা এখনও সম্যক অবহিত নন। এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ভিস্তারার উড়ানকে স্বাগত জানিয়েছেন বলে আনুষ্ঠানিক ভাবে বয়কটের পুরনো সব নির্দেশ খারিজ হয়ে যাবে কি না, বলা মুশকিল!’’ তবে মমতার কথার প্রতিধ্বনি করেই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘কৃষকদের জমি জোর করে কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে তখন আন্দোলনের সময়ে আবেগের কিছু বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।’’ অর্থাৎ পার্থবাবুর কথাতেও ইঙ্গিত যে, অতীতের সেই ‘আবেগ’ এখন আর অত প্রবল নয়! কিন্তু আবেগের আস্তরণ সরিয়ে যুক্তির পথে রাজ্য সরকার এগোবে কি? স্পষ্ট উত্তর নেই তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে।

মহাসচিব বল ঠেলে দিচ্ছেন টাটার কোর্টেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা এখনও আশা করি, টাটা কর্তৃপক্ষ সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দিয়ে দেবেন। কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিয়ে বাকি জমিতে টাটা কারখানা করুক, আমাদের আপত্তি নেই।’’ রাজ্য কি টাটার সঙ্গে আদালতের বাইরে আলোচনায় যাবে? পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমরা তো বারবার বলছি, টাটা অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিক। তাতে সকলের ভাল।’’

আদালতের বিচারাধীন বলে সিঙ্গুর নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ টাটা মোটরসের মুখপাত্র। তবে সূত্রের খবর, টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গুর-পর্বকে রতন টাটার ব্যক্তিগত অপমান বলে মনে করে। কারণ, তৎকালীন টাটা মোটরস পরিচালন পর্ষদের মতের বিপরীতে হেঁটে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সংস্থাকে এ রাজ্যে বিনিয়োগের পথে নামান রতন টাটা।

বণিক মহলের একাংশের মতে, সরকারের এখন মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই। তারা টাটাদের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনাও করতে পারছে না। আবার, সিঙ্গুরের জমির দাবি তুলে নেবে তা-ও বলতে পারছে না। এক শিল্পকর্তার কথায়, মুখে না বললেও এ রাজ্যে টাটাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায় সরকারের থাকবেই। কারণ সরকার জানে সিঙ্গুরের মানুষ এখন ক্ষুব্ধ। অন্য দিকে শিল্পমহলের কাছেও তারা অস্বস্তিতে। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী ভিস্তারার প্রতি যে আতিথেয়তা দেখালেন, সেটা কি বরফ গলার ইঙ্গিত হতে পারে? বেঙ্গল চেম্বার্সের প্রাক্তন কর্তা কল্লোল দত্ত বলেন, ‘‘শুক্রবার বাগডোগরা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী যে সৌজন্য দেখিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তবে রাতারাতি কোনও সরকারের পক্ষে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া তো সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার আরও একটু বেশি উদ্যোগী হলে রাজ্যেরই লাভ।’’

রাজ্য সরকার অবশ্য মনে করে, টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে। নবান্নের এক প্রবীণ মন্ত্রীর দাবি, সিঙ্গুরের পরও টাটারা এ রাজ্য নতুন বিনিয়োগ করছে। খড়্গপুরে টাটা হিতাচি, টাটা মেটালিক্স ও টেলকো কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে। রাজারহাটে দেশের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প করছে তারা। টাটা গোষ্ঠী অবশ্য এই বিনিয়োগ-প্রক্রিয়াকে তেমন গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে টাটার নানা ব্যবসা চালু রয়েছে। তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিনিয়োগ করতেই হবে। কিন্তু পরিবর্তনের সরকারের আমলে নতুন কোনও উৎপাদন প্রকল্প বা কোনও বড় বিনিয়োগ হয়নি রাজ্যে। তবে গত চার বছরে রাজ্যের সব ক’টি শিল্প সম্মেলনে টাটাদের প্রতিনিধিরা হাজির থেকেছেন। শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন পার্থবাবু বার কয়েক টাটা গোষ্ঠীর কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। বর্তমান শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রও টাটার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আবার সেই অমিত মিত্রই বলেছিলেন, টাটার নাকি ‘মতিভ্রম’ হয়েছে। তাঁকে সঙ্গত করেছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কেন? কারণ, কলকাতায় এসে রতন টাটা ‘রাজ্যে শিল্পের ছবি’ নিয়ে সদর্থক কথা বলেননি। সিঙ্গুর-পর্বে রতন টাটাকে প্রায়ই ‘টাটাবাবু’ বলে উল্লেখ করতেন মমতা। আবার গুজরাতের সানন্দে ন্যানো কারখানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে পার্থক্য কী জানতে চাওয়া হলে রতন টাটার জবাব ছিল, ‘‘আমি মনে করি, এক জন ভাল ‘এম’ আছেন, আবার এক জন খারাপ ‘এম’ আছেন। আমাদের পরিবর্তন প্রয়োজন।’’ এর জবাব দিয়েছিলেন মমতাও। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে বিপুল জয়ের পর মমতার বক্তব্য ছিল, ‘‘আমি কিন্তু আবার ওঁকে (রতন টাটা) গুড মর্নিং বলব। উনি আমাদের সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা বলেছেন। কিন্তু আমরাও খারাপ ভাষা ব্যবহার করলে সেটা ঠিক হবে না।’’

ভিস্তারা-র হাত ধরে এই তিক্ত তরজা সমাপ্ত হবে কি না, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। শাসক দল মুখে বলছে, মুখ্যমন্ত্রী নিছক সৌজন্যই দেখিয়েছেন বাগডোগরায়। এ নিয়ে হইচই করা অর্থহীন। কিন্তু দলের অন্দরে অনেকেই স্বীকার করছেন, বৃহস্পতিবারের ঘটনাটা বিরল বটে! পনেরো মিনিট পরেই তাঁর কলকাতায় ফেরার বিমান ধরার কথা। তবু সময় বার করলেন মমতা। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে একটু আগেই শুনেছেন যে, প্রথম বার মাটি ছুঁতে চলেছে ভিস্তারার বিমান। নিজে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে টারম্যাকে অপেক্ষা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।

বিরোধীদের দাবি, এটা সুবিধাবাদী রাজনীতি। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘দেশি সংস্থা হিসেবে টাটা যখন ছোট গাড়ির কারখানা করতে চাইল, দিদিমণি তাদের বললেন, ‘বাই বাই’। এখন বিদেশি সংস্থার সহযোগে সেই টাটার উড়োজাহাজকে তিনি বলছেন, ‘এস ভাই’! হয়তো, সিঙ্গাপুরটা ওঁর বেশি পছন্দ হয় বলেই!’’ কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানও বললেন ‘‘যখন যা করলে নিজের সুবিধা হয়, তৃণমূল নেত্রী তা-ই করেন। টাটার নুন এক কালে খেতে বারণ করেছিলেন। এখন টাটার বিমান পরিষেবাকে স্বাগত জানাচ্ছেন।’’ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য তথাগত রায়ের কটাক্ষ, ‘‘টাটার আসা কিংবা রাজ্যের শিল্পায়ন। কিছুতেই মুখ্যমন্ত্রীর যায়-আসে না। তিনি শুধু জানেন, নির্বাচনে জিততে হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement