তাঁর কার্টুন ই-মেলে ফরওয়ার্ড করে গ্রেফতার হতে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে। প্রায় বছর তিনেক আগে। বুধবার সেই তিনিই বললেন, “সমালোচনা আমি ওয়েলকাম করি...।” মুখ্যমন্ত্রী এমন মন্তব্য করার আগেই অবশ্য মঙ্গলবার রাতে এক তৃণমূলকর্মীকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর অনুগামীদের বিরুদ্ধে। খোদ মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক ওই তৃণমূলকর্মীর ‘অপরাধ’, তাঁর ফেসবুক পেজে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লেখা একটি খবর ‘ট্যাগ’ করা হয়েছে!
সমালোচনা শোনার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনীহার কথা রাজ্যবাসীর অজানা নয়। তাঁর বিরুদ্ধে খবর প্রচারিত হলে প্রকাশ্য সভায় সংবাদমাধ্যমকে হুমকি দেওয়া তাঁর কাছে জলভাত। এমনকী, সরকারি গ্রন্থাগারে কোন সংবাদপত্র রাখা হবে, তা ঠিক করে দেওয়া থেকে শুরু করে আনন্দবাজার সংস্থার যাবতীয় খবরের কাগজ, সংবাদ চ্যানেল না-দেখার ফতোয়া পর্যন্ত জারি করে দিয়েছেন তিনি। জনসভায় সারের দাম নিয়ে প্রশ্ন করে ‘মাওবাদী’ আখ্যা পেয়েছিলেন বিনপুরের শিলাদিত্য চৌধুরী। জেলেও যেতে হয়েছিল তাঁকে। জেলে যেতে হয়েছিল হরিশ্চন্দ্রপুরের যুবক বাপি পালকেও। ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করায়। এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়েরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। বাপি পালের মন্তব্যের নিন্দা করলেও পুলিশি তৎপরতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন বিরোধীরা। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, চূড়ান্ত অশালীন কথা বলে তাপস পাল বা পুলিশকে হুমকি দিয়ে অনুব্রত মণ্ডল রেহাই পেয়ে গেলেও বাপির ক্ষেত্রে এমন তাড়া কেন? গ্রেফতার হওয়ার পরে তৃণমূলের সমর্থক আইনজীবীদের বাধায় গোড়ায় আইনি সাহায্যও পাননি বাপি। যার পিছনে শাসক দলের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তির প্রতিফলনই দেখেছিলেন বিরোধীরা।
এ হেন অতীতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মমতা বুধবার নজরুল মঞ্চে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আমি জানি, সবাই তো সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। সমালোচনা হতেই পারে। সেই সমালোচনা আমি ওয়েলকাম করি।” মঙ্গলবারই রামপুরহাটের প্রশাসনিক সভায় তিনি বলেছিলেন, “ঔদ্ধত্য মানুষ মেনে নেয় না।” তার পর এ দিন এই মন্তব্য। যা শুনে তৃণমূল নেতাদেরই একটা অংশ বলছেন, “দিল্লির ভোট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রাজনীতিতে অহঙ্কারের কোনও জায়গা নেই। সমালোচনা স্বীকার করে নিয়ে মানুষের পাশে থাকলেই সাফল্য আসে। কেজরীবাল নিজেও সেই কথা বলেছেন। এ সব দেখেশুনে দিদির যদি বোধোদয় হয়, তবেই মঙ্গল!”
মমতা মুখে সমালোচনা শোনার কথা, ঔদ্ধত্য না-দেখানোর কথা বললেও তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের বোধোদয়ের কোনও লক্ষণ অবশ্য এখনও নেই। মঙ্গলবার রাতে তৃণমূলের মালদহ জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনকে ট্রেনে তুলে দিতে মালদহ টাউন স্টেশনে গিয়েছিলেন তৃণমূল কর্মী কাজল গোস্বামী। ইংরেজবাজারের কালীতলার বাসিন্দা কাজলবাবুর এলাকার কাউন্সিলর হলেন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। সম্প্রতি কাজলবাবুর ফেসবুকে তাঁর কোনও বন্ধু একটি খবর ‘ট্যাগ’ করেন। ওই খবরে বলা হয়েছে, সারদা-কাণ্ডে কৃষ্ণেন্দুবাবুকে ডাকতে পারে সিবিআই।
স্টেশনে কাজলবাবুকে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মন্ত্রী। তাঁর নিজের এলাকার কোনও লোকের ‘এত সাহস’ কী ভাবে হল, জানতে চান তিনি। কাজলবাবুর দাবি, তিনি বেশ কয়েক বার বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ওই খবর তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেননি। তাঁকে কেউ ট্যাগ করেছে। কিন্তু মন্ত্রী সে সবে কান দেননি। উল্টে গালিগালাজ করে মারধরের হুমকি দেন বলে অভিযোগ। কাজলবাবুর বক্তব্য, “বাদানুবাদ চলতে চলতেই মন্ত্রীর সঙ্গে থাকা ৮-১০ জন আমাকে ঘিরে বেধড়ক মারে। রাস্তায়ফেলেও পেটায়। পরে স্থানীয়েরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এর পরে ওরা আমার বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয়, অভিযোগ দায়ের করলে বাড়িছাড়া করবে। স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে আতঙ্কে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ভয়ে থানায় পর্যন্ত যেতে পারছি না।” এই ব্যাপারে ফোন করা হলে কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, “ব্যস্ত রয়েছি। পরে কথা বলব।” তার পর আর তাঁর যোগাযোগ করা যায়নি। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “অভিযোগ শুনেছি। দল যেমন নির্দেশ দেবে, সেই মতো পদক্ষেপ করা হবে।”
মমতা-মুকুলের কার্টুন ফরওয়ার্ড করায় যাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, সেই অম্বিকেশ মহাপাত্র বলেন, “এমন ঘটনা এ রাজ্যে বারবার ঘটছে। যখনই কারও কথা পছন্দ হচ্ছে না, তখনই তাঁর উপরে শাসক দলের আক্রমণ নেমে আসছে। এই ঘটনায় কেবল কাজল গোস্বামীর মুখ বন্ধই করা হচ্ছে না, গোটা রাজ্যকেই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, রাজ্য সরকারের সমালোচনা সহ্য করা হবে না।”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন নজরুল মঞ্চে পুলিশের একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ভুল করার প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, “মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। ভুলটা শুধরে নিতে হয়। একটা ছোট্ট ভুল সরকারের ফেসকে অনেক সময় খারাপ করে দেয়। আবার একটা ভাল কাজ সরকারের কাজকে অনেক বেশি সুন্দর করে তোলে।” বিরোধীরা যা শুনে বলছেন, এই সরকারের সবটাই ভুল, সংশোধনের ব্যাপারই নেই। বরং লাগাতার সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাকে ‘কুৎসা’ বলে দোপ দেগে আসা মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন ভোল বদল দেখে তাঁরা রীতিমতো চমকিত! সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “এ তো ভূতের মুখে রামনাম! শতাব্দীর সেরা রসিকতা!” আর বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর কথা আর কাজ সম্পূর্ণ উল্টো! সমালোচনাকে উনি আসলে ‘বাঁশ’ মনে করেন!” বিরোধীদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ ভাল সাজতে চাইলে কী হবে, দলের আসল মুখ কৃষ্ণেন্দুই ফের দেখিয়ে দিয়েছেন!
আর ভুক্তভোগী বাপি পালের প্রতিক্রিয়া, “কারও কথা অপছন্দ হলেই যে যা খুশি ঘটতে পারে, এটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। অভিযোগ পাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে তুলে নিয়ে গেল। অথচ কত বড় বড় ঘটনা ঘটে। কিছুই হয় না।”