পাঁচ বছর আগে সিঙ্গুর আন্দোলনে ভর করে রাজ্যের মসনদে বসার পথ প্রশস্ত করেছিলেন তিনি। আর একটা বিধানসভা ভোটের আগে সেই সিঙ্গুরকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে মমতার প্রথম কাজই ছিল সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দিতে আইন তৈরি করা। তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল এটাই। কিন্তু সেই আইনই এখন আটকে আইনের ফাঁসে। কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ আইন বৈধ বললেও তা খারিজ করে দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। তার পর মামলা গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। ২০১২-র জুনে জমি ফেরানো স্থগিত রাখতে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সেই থেকে ঝুলে রয়েছে মামলাও।
বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে করতে ক্রমেই হতাশা বেড়েছে সিঙ্গুরবাসীদের। ‘কেন টাটাদের কারখানার বিরোধিতা করলাম। কেন ক্ষতিপূরণের টাকা নিলাম না। এখন তো আমাদের দু’কুলই গেল।’— এই আক্ষেপ এখন শোনা যায় সিঙ্গুরে কান পাতলেই। তৃণমূল নেতাদের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিতেও ছাড়েন না তাঁরা।
এই অবস্থায় শুক্রবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সিঙ্গুরের ব্যাপারে কার্যত হাত ধুয়ে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন ‘‘আপনাদের (বাম) শিল্পায়ন মানে তো সেই সিঙ্গুরের গল্প! আমরা কিন্তু সিঙ্গুরের জমি ফেরতের আইন করে দিয়েছি। বিষয়টা আদালতের বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টকে আমরা সম্মান করি। আমরা কিন্তু আমাদের কাজ করে দিয়েছি।’’ এক বাম বিধায়ক প্রশ্ন তোলেন, ‘‘পাঁচ বছর হয়ে গেল। কৃষকেরা জমি ফেরত পাবেন কবে?’’ মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘‘ওটা আদালতের ব্যাপার। পাঁচ বছর কেন, ৫০ বছর লাগলেও কিছু করার নেই!’’
মুখ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্য শোনার পরেই সিপিএম নেতৃত্ব পাল্টা আক্রমণে গিয়ে বলেছেন, সিঙ্গুরের দায় আসলে পাঁচ বছর আগেই ঝেড়ে ফেলেছেন মমতা। আইন করার সময়েই তিনি জানতেন, আদালতের সামনে এমন যুক্তি টিকবে না। বামেরা যে সব সংশোধনী এনেছিল, তা গ্রহণই করা হয়নি। যা গ্রহণ করলে বিলটির বেঁচে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। হাইকোর্ট আইন খারিজ করে দেওয়ার পরে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে রাজ্য। মামলা চালাতে কোষাগারের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে বলে সরব বিরোধীরা। সূর্যবাবু এ দিন বলেছেন, ‘‘ঝুলি থেকে এ বার বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে! মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তার পরে আর কিছু বলার থাকে না! সৎসাহস থাকলে উনি সিঙ্গুরে গিয়ে বলে আসুন, কৃষকদের জন্য আমাদের আর কোনও দায়িত্ব নেই!’’
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, জমি ফেরতের বিষয়টি আদালতের বিবেচনাধীন হয়ে যাওয়ায় তার উপরে এখন শুধু সরকার কেন, কারওরই কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনি জট ছাড়িয়ে কবে জমি ফেরত দেওয়া যাবে, নিশ্চিত করে তা বলা সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রী সেটাই বলতে চেয়েছেন। সিঙ্গুর আন্দোলনের নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী বেচারাম মান্নার কথায়, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সিঙ্গুরকে ভোলেননি, তার বড় প্রমাণ চাষিদের জন্য দু’টাকা কেজি চাল ও দু’হাজার টাকা মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা। এখন পুরো বিষয়টা আদালতের চৌহদ্দিতে। বিষয়টা মিটে গেলেই জমি ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে সেই বিশ্বাস সিঙ্গুরবাসীর আছে।’’
অনিচ্ছুক চাষিদের সঙ্গে কথা বলে অবশ্য তেমন আস্থার ছবি এ দিন ফুটে ওঠেনি। আন্দোলনরত চাষিদের এক জন, গোপালনগর ঘোষপাড়ার বাসিন্দা রঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘‘আইন তো সরকার করেছিল চাষিদের জমি ফেরত দেওয়ার জন্য। সেটাই যদি না হয়, তা হলে আইন করে কার লাভ হল? এখন আবার সেই আইনেরই দোহাই দিচ্ছে শাসক দল!’’ সিঙ্গুরবাসীদের অনেকেরই বক্তব্য, কারখানা না-হওয়ায় এলাকার আর্থিক বিকাশ হল না। তৈরি হল না বিকল্প রোজগারের পথ। তার উপর জমি ফেরত না-পেয়ে কার্যত পথে বসলেন তাঁরা। অধিকাংশ অনিচ্ছুক চাষিই বলেছেন, সরকারি ডোল স্থায়ী আয়ের বিকল্প হতে পারে না।
কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবেরও প্রশ্ন, ‘‘সস্তার চাল আর মাসিক ভাতা পাওয়ার জন্য কি সিঙ্গুরে আন্দোলন হয়েছিল? আমরা ভেবেছিলাম, সিঙ্গুর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও স্পষ্ট আশ্বাস পাওয়া যাবে। কিন্তু তা তো হলই না। উল্টে মুখ্যমন্ত্রী এমন কথা বলে দিলেন!’’
এই পরিস্থিতিতে আসন্ন বিধানসভা ভোটে সিঙ্গুর তথা শিল্পায়নের প্রশ্নে রাজ্য জুড়ে আলোড়ন তোলা সম্ভব বলেই বিশ্বাস বিরোধীদের। বামেরা আগেই ঘোষণা করেছে, ভবিষ্যতে ফের ক্ষমতায় এলে তারা সিঙ্গুরে কারখানাই করবে। গত মাসেই শিল্পের দাবিতে বামেদের শালবনি পর্যন্ত পদযাত্রা শুরু হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে। যেখানে গিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘কী হল সিঙ্গুরের? কারখানা হল না। ছেলেমেয়েদের কাজ হল না। আর কৃষকেরা কী পেলেন?’’
বিধানসভায় দাঁড়িয়ে প্রাক্তনের সেই প্রশ্নেরই জবাব প্রায় দিয়ে দিলেন বর্তমান!