মঙ্গলবার বণিকসভার অনুষ্ঠানে। সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
পাখির চোখ এ বার শিল্পায়ন।
গত মাসের ২৭ তারিখ মুখ্যমন্ত্রিত্বে দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর সময়ই নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন শিল্পে জোর দেওয়ার কথা। ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, প্রথম দফায় গ্রাম ও কৃষিতে নজর দেওয়ার পরে এ বার তাঁর লক্ষ্য শিল্প, শহর আর কর্মসংস্থান। মঙ্গলবার রাজ্যের বণিকসভাগুলির সঙ্গে যৌথ বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন লক্ষ্যপূরণে দৃঢ়সঙ্কল্প তিনি। আর তাই আসন্ন রোম সফরকে শুধুমাত্র মাদার টেরিজার সন্ত হওয়ার অনুষ্ঠানে হাজির থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী। এক যাত্রায় বিপণনের কাজটাও যতটা সম্ভব সেরে নিতে চান। রাজ্যের শিল্পপতিদের মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানালেন, ওই সফরের ফাঁকেই ইতালির শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চান তিনি। ফেরাতে চান র গাড়ি (অটোমোবাইল) এবং উৎপাদন শিল্পের হারিয়ে যাওয়া গৌরব।
রাজ্যে বড় শিল্পে লগ্নির খরার ইতিহাস দীর্ঘ। মমতার প্রথম ইনিংসেও ব্রাত্যই থেকেছে বড় শিল্প। তখন মুখ্যমন্ত্রীর মুখে বারবারই উঠে আসত মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের কথা। তাঁর সরকারের নীতির অভিমুখও ছিল মূলত গ্রাম। রাজনীতিকদের মতে, এ বারের ভোটে গ্রামবাংলা তাঁর সেই ‘বদান্যতার’ ঋণ কড়ায় গণ্ডায় শোধ দিয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর পরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বোঝা যখন আরও ভারী হবে, তখন শুধু গ্রামীণ ভোট দিয়ে বৈতরণী পেরোনো কঠিন। তাই এ দফায় মমতাকে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের উপরে জোর দিতেই হবে। তৃণমূল নেত্রী নিজেও সে কথা জানেন।
তাই মমতা নিজে যেমন উদ্যোগী, তেমনই চাপ দিয়েছেন শিল্পপতিদেরও। শিল্পমহলকে রীতিমতো তাড়া দিয়ে এ দিন তিনি বলেন, ‘‘কথার বদলে কাজ করে দেখান। মন্দা বা অন্য সমস্যার দোহাই না দিয়ে কাজ শুরু করে দিন। সমস্যায় পড়লে সরকার সামলাবে।’’
দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) নেতৃত্বে রাজ্যের একগুচ্ছ বণিকসভা এ দিন মমতাকে সংবর্ধনা দেয়। তাঁর শিল্পভাবনার বার্তা দিতে সেই মঞ্চকেই বেছে নেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী সেপ্টেম্বরে ভ্যাটিকানে মাদার টেরিজাকে সন্তের মর্যাদা দেবেন পোপ ফ্রান্সিস। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন মমতা। তখনই আশপাশে কিছু শিল্প-বৈঠক সেরে নেওয়া যায় কি না তা খতিয়ে দেখতে এ দিনের মঞ্চ থেকেই শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রকে নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘পোপের আমন্ত্রণে যখন যাবই, তখন এক বারেই দু’টো কাজ করা যায়। কারণ, বারবার বিদেশে গিয়ে বসে থাকার সময় নেই। প্রধানমন্ত্রীর থাকতে পারে। তাই আট ঘণ্টার পথে যখন যাচ্ছি, তখন আরও দু’ঘণ্টা সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে একসঙ্গে সবটা করে নিতে চাই। রাজ্যে অটোমোবাইল, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে।’’
ছোট ও মাঝারি শিল্পের গণ্ডি পেরিয়ে অবশেষে বড় শিল্পে লগ্নির টানার এই ভাবনায় স্বাভাবিক ভাবেই খুশি শিল্পমহল। অটোমোবাইল শিল্প সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যও তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। রাজ্যে গাড়ি শিল্পের একমাত্র সলতে হিন্দমোটরের ঝাঁপ এখন বন্ধ। সেই কারখানার একাংশে এখন গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্প। সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা গড়ে উঠলে গাড়ি শিল্পে জোয়ার লাগতে পারত বলে শিল্পমহলের ধারণা। কিন্তু জঙ্গি আন্দোলনের জেরে টাটাদের বিদায় রাজ্যের ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। শিল্পমহলের অনেকেরই মতে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করার ব্যাপারে অনেক আত্মবিশ্বাসী মমতা। এবং সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করে শিল্পায়নের পথে প্রাথমিক বাধাগুলি তিনি যদি দূর করে ফেলতে পারেন, তা হলে রাজ্যেরই লাভ হবে।
বস্তুত এ দিনের অনুষ্ঠানের মূল থিমই ছিল আত্মবিশ্বাস। মঞ্চে উঠেই মুখ্যমন্ত্রী জানান, সাধারণত কোনও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি যান না। কিন্তু এই অনুষ্ঠানকে তিনি আলাদা চোখে দেখেছেন। তার কারণ ‘আত্মবিশ্বাস’। মমতা বলেন, ‘‘নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর অনেক আগেই আইসিসি-র প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত কল আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, নির্বাচনের পরে আমি যেন ওঁদের অনুষ্ঠানে যাই। এই আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়কে সম্মান দিতেই আমি এখানে এসেছি।’’
এই আত্মবিশ্বাসই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন শিল্পমহলে। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, কোনও সমস্যার দোহাই দিয়ে কাজ থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। তা সে মন্দাই হোক বা অন্য কোনও সমস্যাই হোক। ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকলেও চলবে না। মমতার কথায়, ‘‘মন্দা চলছে বলে সব সময় চুপ করে বসে থাকলে চলবে? তা হলে তো বাড়িতে বসে হরে রাম হরে কৃষ্ণ করতে হয়।’’
পাঁচ বছর আগে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বলেছিলেন, “ডু ইট ইমিডিয়েটলি।” সঙ্গে এটাও যোগ করেছিলেন, না পারলে সেটাও বলে দিতে। কিন্তু এ বার আর কোনও অজুহাত শুনতে তিনি নারাজ। এ দিন নির্মাণ শিল্পসংস্থাদের সংগঠন ক্রেডাইকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ছ’টি থিম সিটি-সহ ২৩/২৪টি শহর আমাদের আছে। জমি রয়েছে। আপনারা কেন করছেন না? না করে ফেলে রাখলে হবে?’’
শিল্পমহলকে আস্থা জোগাতে কেন্দ্রীয় সরকারকেও পরোক্ষে নিশানা করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘আজ ইনকাম ট্যাক্স। কাল ইডি। পরশু সিবিআই। ভয় পাচ্ছেন শিল্পপতিরা। ৭৫ হাজার শিল্প দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে।’’ এই সব ভয় দূরে সরিয়ে রেখেই রাজ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণ করার আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তবে এত আশ্বাস সত্ত্বেও কিছু কাঁটা যে শিল্পমহলের মনে বিঁধে থাকে, তা মুখ্যমন্ত্রী জানেন। যেমন সিন্ডিকেট ও তোলবাজি সমস্যা। যা গত ক’বছরে রীতিমতো ভুগিয়ে চলেছে প্রায় সব শিল্পকেই। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সরাসরি সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ তোলেননি। তবে শিল্পমহলকে পরোক্ষে বরাভয় দিয়ে বলেছেন, ‘‘এ রাজ্যেই কাজের সবচেয়ে ভাল পরিবেশ রয়েছে। কখনও স্থানীয় কোনও সমস্যা হতে পারে। তা ঠিক জায়গায় জানালে সমাধান নিশ্চয় হবে। একটি পরিবারেও সবার উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’’
এক ঘণ্টার একটু বেশি সময়ের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সোজাসাপ্টা বক্তব্য শিল্পমহলের মন ছুঁয়ে গিয়েছে। তবে শুধু আবেগ নয়। শিল্পমহলের মতে, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও আছে। ফিকি-র হর্ষ নেওটিয়া, আইসিসি-র সিদ্ধান্ত কল, বেঙ্গল চেম্বারের অম্বরীশ দাশগুপ্ত, ক্রেডাইয়ের সুশীল মোহতা, এমসিসি-র মণীশ গোয়েন্কা থেকে শুরু করে ভারত চেম্বারের রাকেশ শাহ, বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বারের জি পি সরকার, সকলেই এক বাক্যে জানান, যে ভাবে উৎপাদন শিল্প ও নগরায়নের রূপরেখা তৈরি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতে সরকারের লক্ষ্য এবং লক্ষ্যপূরণের রূপরেখা স্পষ্ট।