মোদীর সঙ্গে আলাপচারিতায় মমতা। সোমবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সৌজন্যে।
বেশ কিছু দিন বাদে সংসদের অলিন্দে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
চলতি সফরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঋণ মুকুবের দাবি তো ছিলই। একই ঝোলায় ছিল রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় সাহায্যের দাবি-দাওয়াও। আর তাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আজ তাঁকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গিয়েছে গোটা সংসদ ও সেন্ট্রাল হলে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্প যে মন্ত্রকের লাল ফাঁসে আটকে রয়েছে, দেখা করে আলোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট সেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে। তা সে অরুণ জেটলি হোন, সুরেশ প্রভু থেকে বেঙ্কাইয়া নায়ডু মমতার তালিকায় অচ্ছুত ছিলেন না কোনও বিজেপি নেতাই। দাবি পূরণ হবে কি না তা নিয়ে ঘোর সংশয় থাকলেও, আদায় করে নিয়েছেন কিছু না কিছু আশ্বাস। রাজ্যের দাবিদাওয়ার পাশাপাশি সংসদে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ের জন্য দরবার করতে বিনা নোটিসে হাজির হয়েছেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের দফতরে। জমি বিল কিংবা কাশ্মীর বিতর্ক নিয়ে আজ একাধিকবার সংসদ উত্তাল হয়েছে বটে, কিন্তু দিনভর সংসদে সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তৃণমূল নেত্রীই। আর দিনভর সংসদ চত্বরে আলোচনার চর্চাতে ছিল মোদী-মমতা বৈঠকই।
এই মমতাই লোকসভা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, চাইলে মোদীকে কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরাতে পারেন। এমনকী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে এই ন’মাসে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে নিজে থেকে সাক্ষাৎ তো দূর, সৌজন্য বার্তাটুকুও পাঠাননি মমতা। মাঝে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নৈশভোজ উপলক্ষে হঠাৎ দেখা ও দু’টি বাক্য বিনিময় হয়েছিল। এ যাবৎ দুই নেতা-নেত্রীর মুখোমুখি সাক্ষাৎ পর্ব ছিল এ টুকুই। আজ কিন্তু একেবারে অন্য চিত্র। যে মোদীর সঙ্গে দেখা করবেন না বলে কার্যত ধনুক পণ ভাঙা পণ করেছিলেন, আজ সেই মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই সংসদে পৌঁছে যান মমতা। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে তখন সংসদের মূল প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়িয়ে গোটা তৃণমূলের সংসদীয় ব্রিগেড। তাঁরাই সদলবলে নেত্রীকে নিয়ে যান সেন্ট্রাল হলে। সাংসদদের ভিড়ে লক্ষণীয় অনুপস্থিত ছিলেন রাজ্যসভার দুই বিতর্কিত সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান ও কে ডি সিংহ। ছিলেন না তাঁদের আরও দুই সদস্য মুকুল রায় ও মিঠুন চক্রবর্তী। এ বিষয়ে অবশ্য রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “মিঠুন আগে থেকে বলেই ছুটি নিয়েছেন। আর মুকুল রায় এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যার সঙ্গে দলের নীতি খাপ খায় না। তাই তাঁকে ডাকা হয়নি।”
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতার একান্তে বৈঠক ছিল বেলা বারোটায়। কিন্তু লোকসভায় কাশ্মীর বিতর্ক ইস্যুতে সরকারের অবস্থান জানাতে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থাকায় বৈঠক ক্রমশ পিছোতে থাকে। মমতা দু’বার এসে সংসদের লাইব্রেরিতে সাংবাদিকদের কাছে জানতে চান, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হল কিনা। অপেক্ষা শেষ হয় সাড়ে বারোটা নাগাদ। ততক্ষণে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তাদের সবিস্তার বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের আর্থিক সমস্যাটি ঠিক কোথায়। দাবিটিও ঠিক কী। এর পর সংসদে থাকা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে শুরু হয় একান্ত বৈঠক। চলে প্রায় পঁচিশ মিনিট।
পরের বৈঠক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতা ও দলের সাংসদদের। বৈঠকস্থল, সংসদের ভবনের বাইরে অবস্থিত নতুন গ্রন্থাগার ভবন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক শেষ হতেই মোদীর ঘরের সামনে অপেক্ষারত দলীয় সাংসদদের নিয়ে ওই ভবনের দিকে হাঁটা লাগান মমতা। প্রায় দৌড়ে, একশো মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ঢুকে পড়েন সেখানে। জল্পনা ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মোদী যে ভাবে এক সঙ্গে হেঁটে গিয়েছিলেন, এ ক্ষেত্রেও কি মোদী-মমতা ওই দূরত্ব এক সঙ্গে পার হবেন?
তা অবশ্য ঘটেনি। মমতা চলে যাওয়ার প্রায় দশ মিনিট পরে নিজের দফতর থেকে বের হন মোদী। সঙ্গে তাঁর আমলারা। শুরু হয় তৃণমূলের সংসদীয় দলের সঙ্গে বৈঠক। নিরাপত্তা ও স্থানাভাবের কারণে ওই ঘরে অবশ্য ঢুকতে পারেননি বেশ কিছু সাংসদ। বেজার মুখে তাঁদের বেরিয়ে আসতে দেখা যায় পাঠাগার ভবন থেকে। এই বৈঠকটিও চলে প্রায় আধ ঘণ্টা। অবশেষে মমতাকে মধ্যমণি করে বেরিয়ে আসেন অন্য সাংসদরা। সাংবাদিকদের সঙ্গে টুকরো আলাপচারিতা সেরেই মমতা ফিরে যান সংসদের সেন্ট্রাল হলে। সেখানে ফিরতেই রাজ্যের অন্য প্রকল্পগুলির জন্য তদ্বির করতে সক্রিয় হয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। রীতিমতো চরকির মতো পাক খেতে শুরু করেন তিনি। এক দিকে পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। অন্য দিকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের দাবি দাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা। মমতার সঙ্গে দেখা করতে আসেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হতেই মমতা দাবি করেন, একশো দিনের কাজ প্রকল্পে বকেয়া অর্থ কেন্দ্রের ঘরে পড়ে রয়েছে। তা দ্রুত ছেড়ে দেওয়া হোক। যা নিয়ে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মমতার দাবি মেনে নেন জেটলি। আশ্বাস দিয়েছেন, দ্রুত ওই টাকা দিয়ে দেওয়া হবে রাজ্যকে।”
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে দীর্ঘ সময় রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। গত সরকারের রেলমন্ত্রী হিসেবে তিনটি বাজেটে রাজ্যের জন্য ঘোষণা করেছিলেন একাধিক রেল প্রকল্প। সেই সব প্রকল্পের বাস্তব ভিত্তি নিয়ে সংশয় থাকলেও আজ রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর সঙ্গে দেখা করে কলকাতা মেট্রোর থমকে যাওয়া প্রকল্প-সহ রাজ্যের মোট ৩৪টি রেল পরিকল্পনার জন্য বাড়তি অর্থের দাবি জানান মমতা। রেলের ভাঁড়ারে অর্থের টানাটানি হলেও সেই দাবি অন্তত খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন প্রভু। তিনি বলেন ২০ মার্চের মধ্যে এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ করবে রেল। কয়লা খনি নিলামের জন্য যে অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছে, তা নিয়ে জটিলতা কাটাতে মমতার সঙ্গে আলোচনা করেন কয়লামন্ত্রী পীযূষ গয়াল। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান সময়ে আসার দাবিতে মমতা কথা বলেন ওই মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত বেঙ্কাইয়া নায়ডুর সঙ্গে। একইাধারে সংসদীয় মন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাছে দলের জন্য সংসদে দলীয় কার্যালয়ের তদ্বির করার সুযোগটিও হাতছাড়া করেননি তৃণমূল নেত্রী। পরে তিনি ওই একই দাবি জানিয়ে আসেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের কাছেও। অতীতের মতো আজও দু’জনেই দ্রুত ঘর-সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে সংসদ ছাড়েন মমতা। ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, চলতি দিল্লি সফরে ফের এক বার সংসদে ঢুঁ মারার কথা রয়েছে তাঁর।